যানাজা ও দাফন কাফন সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর পর্ব ০১

By | Fri 9 Jumada Al Akhira 1437AH || 18-Mar-2016AD

যানাজা ও দাফন কাফন সম্পর্কিত মাসিক আল-কাউসার পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সঙ্কলন এই পোস্টটি। যে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে এই পোস্টে তা নিচে দেয়া হলঃ

  1.  (আ-কাঃ ৩৬৩৫) রমযানের শেষ দশকে সুন্নত ইতিকাফকারী ব্যক্তি জানাযার নামাযে শরিক হতে পারবে কি না?
  2. (আ-কাঃ ৩৬৩১) ক) মায়্যেতের গোসলদাতা ও দাফনকার্য সম্পাদনকারী যেমনকবর খননকারীবাঁশ কর্তনকারী ইত্যাদি লোকদেরকে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে কোনো বিনিময় দেওয়া যাবে কি না?খ) মায়্যেতের পরিধেয় কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য আসবাবপত্রের হুকুম কী?গ) মাইয়্যেতের দাফনকার্য শেষ হলে কবরের পাশে অবস্থান করে কী কী আমল করা যেতে পারে?
  3. (আ-কাঃ ৩৫৬৭) কালিমা তাইয়্যেবার এক লাখ বার পড়ার আলাদা কোন ফযিলত (এ আমলের বরকতে নাকি মৃত ব্যক্তির কবর আযাব মাফ হয়ে যায়) কই কোরান হাদিস দ্বারা প্রমানিত?
  4. (আ-কাঃ ৩৫১২) মসজিদে জানাযার নামায পড়ার হুকুম কীলাশ মসজিদের ভেতরে রাখা বা বাইরে রাখার কারণে কি হুকুমের মাঝে কোনো পার্থক্য হবে?
  5. (আ-কাঃ ৩৫১১) মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে পাথরে বা খোদাই করে বিভিন্ন পঙক্তি, আয়াত, দুআ বা বাণী লিখে রাখার হুকুম কী? এটা কি শরীয়তসম্মত? তাছাড়া কবর সনাক্ত করার জন্য কবরে নাম ও ঠিকানা লিখে রাখতে দেখা যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে তা কি বৈধ?
  6. (আ-কাঃ ৫০৪৫) মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া জায়েয আছে কি না?

উত্তরগুলোর সাথে আল-কাউসারের প্রশ্ন নং উল্লেখ করা হল যাতে আমরা আল-কাউসার থেকে খুজে নিতে পারি প্রয়োজন হলে।



প্রশ্ন ৩৬৩৫: রমযানের শেষ দশকে সুন্নত ইতিকাফকারী ব্যক্তি জানাযার নামাযে শরিক হতে পারবে কি না?

উত্তর: সুন্নত ইতিকাফকারী জানাযার নামাযের জন্য মসজিদের বাইরে গেলে তার ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আয়েশা রা. বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য নিয়ম হল, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাবে না এবং (মসজিদের বাইরে) জানাযার নামাযে শরিক হবে না। …-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৬৫

প্রকাশ থাকে যে, ইতিকাফকারীর জন্য কোনো কারণে বাইরে অনুষ্ঠিত জানাযায় শরিক হওয়া আবশ্যক হলে সে যেতে পারবে তবে এ কারণে তার ঐ দিনের ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে এবং সুন্নত ইতিকাফও থাকবে না। এক্ষেত্রে তাকে একদিন রোযা অবস্থায় ইতিকাফের কাযা করতে হবে।

-আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮০ কিতাবুল আছল ২/১৮৩; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২২; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১২; আলমাবসূত, সারাখসী ৩/১১৮


প্রশ্ন ৩৬৩১:

ক) মায়্যেতের গোসলদাতা ও দাফনকার্য সম্পাদনকারী যেমনকবর খননকারীবাঁশ কর্তনকারী ইত্যাদি লোকদেরকে কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে কোনো বিনিময় দেওয়া যাবে কি না?

খ) মায়্যেতের পরিধেয় কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য আসবাবপত্রের হুকুম কী?

গ) মাইয়্যেতের দাফনকার্য শেষ হলে কবরের পাশে অবস্থান করে কী কী আমল করা যেতে পারে?

উত্তর:

ক) হাঁ, মায়্যেতের গোসলদাতা, কবর খননকারী ও তার সহযোগীদেরকে বিনিময় দেওয়া জায়েয। তবে এসব কাজ বিনিময়হীনভাবে করাই উত্তম।

খ) মায়্যেতের পরিধেয় কাপড়, আসবাবপত্রও মীরাসের অন্তর্ভুক্ত। তাই এগুলোও মীরাসের নিয়ম অনুযায়ী বণ্টন করতে হবে। তবে সকল ওয়ারিশ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগুলো দান করে দিতে চায় তবে তাও জায়েয আছে।

গ) মায়্যেতের দাফন শেষে কবরের পাশে অবস্থান করে নিম্নের আমলগুলো

করার কথা হাদীসে এসেছে।

১। মৃতের মাগফিরাতের জন্য এবং কবরের সওয়ালের জওয়াবে অটল থাকার জন্য দুআ করা। হযরত উসমান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃতের দাফনকার্য সম্পন্ন করতেন তখন কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করো এবং (সওয়ালের-জওয়াবে) অটল থাকার জন্য দুআ করো। কেননা এখনই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩২১৩

২। মৃতের মাথার দিকে অবস্থান করে সূরা বাকারার শুরু এবং শেষের কিছু অংশ তিলাওয়াত করবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. লাশ দাফনের পর তার মাথার দিকে অবস্থান করে সূরা বাকারার শুরু এবং শেষের অংশ পড়া পছন্দ করতেন। -সুনানে বায়হাকী ৪/৫৬


প্রশ্ন ৩৫৬৭: গত কুরবানী ঈদের আগের দিন আমার এক আত্মীয় মারা যায়। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট এক সংখ্যা পরিমাণ কালিমা পড়া হয়। সম্ভবত ১ লক্ষ পরিমাণ। যে কারণে একে লাখ কালিমা বলা হয়। এ আমলকে এতই গুরুত্ব ও এহতেমামের সাথে পালন করা হয় যে, দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জনে জনে তা বণ্টন করে দেওয়া হয় এবং এ আমলের বরকতে নাকি মৃত ব্যক্তির কবর আযাব মাফ হয়ে যায়।

হযরত মুফতী সাহেবের সমীপে আমার জানার বিষয় হলকুরআন-হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে এ আমলের কোনো ভিত্তি আছে কি নাথাকলে তার গুরুত্ব কী পরিমাণ ও আদায়ের তরিকা কীজানালে কৃতজ্ঞ হব।

উত্তর:

কালিমা তাইয়েবার ফযীলত, মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। এটি তাওহীদ ও ঈমানের কালেমা।

ইখলাসের সাথে এ কালেমা পাঠকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে। মীযানের পাল্লায় এ কালেমা সর্বাধিক ভারী হবে। হাদীস শরীফে বিশুদ্ধ সূত্রে এ ধরনের বিভিন্ন ফযীলত ও সওয়াবের কথা এ কালেমা সম্পর্কে এসেছে।

কিন্তু কোনো মৃতের ঈসালে সওয়াবের নিয়তে এ কালেমা এক লাখ পরিমাণ পাঠ করা হলে তার কবর আযাব মাফ হয়ে যায়-এ কথা সহীহ নয়। কুরআন-হাদীসের কোথাও এর প্রমাণ নেই।

সুতরাং মুসলমানদের এ ধরনের মনগড়া কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মৃত ব্যক্তির ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে তার জন্য দান-খয়রাত করা, ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদত করে ঈসালে সওয়াব করা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাই শরীয়ত নির্দেশিত পদ্ধতিতেই আমল করা কাম্য।


প্রশ্ন ৩৫১২: শহরের অনেক মসজিদেই জানাযার নামায আদায় করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত মসজিদের বাইরে সামনের দিকে লাশ রাখার জন্য কিছু খালি জায়গা রাখা হয়। আর ইমাম সাহেব মুসল্লিদের নিয়ে মসজিদের ভেতরই নামাযে জানাযা আদায় করেন।

আমার জানার বিষয় হলমসজিদে জানাযার নামায পড়ার হুকুম কীলাশ মসজিদের ভেতরে রাখা বা বাইরে রাখার কারণে কি হুকুমের মাঝে কোনো পার্থক্য হবে?

উত্তর:

লাশ মসজিদের ভেতরে রাখা হোক বা বাইরে রাখা হোক বিনা ওজরে মসজিদে জানাযার নামায পড়া মাকরূহ। নবী  কারীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,যে ব্যক্তি মসজিদের ভেতর জানাযার নামায আদায় করবে তার কোনো সওয়াব হবে না। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৮৪

মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় আছে, উক্ত হাদীস বর্ণনা করার পর হযরত সালেহ রাহ. বলেন, জানাযার মাঠে জায়গা না হলে সাহাবীরা ফিরে যেতেন। নামাযে শরিক হতেন না। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১২০৯৭

উল্লে­খ্য, মসজিদে নববী সংলগ্ন একটি খালি জায়গা ছিল যেখানে জানাযার নামায আদায় করা হত। দেখুন : আলমাওয়াহিবুল­দুন্নিয়্যা ৩/৩৯৬; ওফাউল ওফা ২/৫৩৪

অবশ্য অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদেও দুজন সাহাবীর জানাযার নামায আদায় করেছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৭৩

এই দুই ধরনের হাদীসের মাঝে ফকীহগণ এভাবে সমন্বয় করেছেন যে, স্বাভাবিক অবস্থায় জানাযার নামায মসজিদের বাইরেই আদায় করবে। আর কোনো ওজর থাকলে যেমন বৃষ্টি হলে অথবা বাইরে পড়ার মতো ব্যবস্থা না থাকলে মসজিদের ভেতরও আদায় করা যাবে।

প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে শহরগুলোতে মসজিদের বাইরে জায়গা না থাকার কারণে মসজিদে জানাযার নামায আদায় করা হয়। তাই তা দোষণীয় হবে না।

-যাদুল মাআদ ১/৫০১; ইলাউস সুনান ৮/২৭৭; রদ্দুল মুহতার ২/২২৬, ২/২২৭; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৫৮০; ফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়া ১/১৫৬; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২২২; কিতাবুত তাজনীস ২/২১৯; আলবাহরুর রায়েক ২/১৮৬; আননাহরুল ফায়েক ১/৩৯৫; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ২/৪৯৪ ফাতহুল কাদীর ২/৯০-৯২; উমদাতুল কারী ৮/২০-২১


প্রশ্ন ৩৫১১: মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে পাথরে বা খোদাই করে বিভিন্ন পঙক্তিআয়াতদুআ বা বাণী লিখে রাখার হুকুম কীএটা কি শরীয়তসম্মততাছাড়া কবর সনাক্ত করার জন্য কবরে নাম ও ঠিকানা লিখে রাখতে দেখা যায়। শরীয়তের দৃষ্টিতে তা কি বৈধআশা করি সবিস্তারে জানাবেন।

উত্তর:

মৃত ব্যক্তির কবরের উপর বা পাশে কুরআনের আয়াত, দুআ, কবিতা বা প্রশংসা-স্তুতিমূলক বাক্য লিখে রাখা নিষেধ। হাদীস শরীফে কবরে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করা, তার উপর লেখা, কবরের উপর ঘর নির্মাণ করা এবং তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০৫২

অবশ্য কখনো কবর সনাক্ত করার প্রয়োজন হলে মৃতের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে রাখার অবকাশ আছে। সাহাবী হযরত উসমান বিন মাযউন রা.-এর কবরের পাশে এ উদ্দেশ্যেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাথর রেখেছিলেন এমন বর্ণনা হাদীস শরীফে এসেছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৯৮

এ বর্ণনার আলোকে ফকীহগণ বলেছেন, কবর পরিচয়ের স্বার্থে কবরের পাশে মৃতের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিখে রাখার অনুমতি রয়েছে।

-আদ্দুররুল মুখতার ২/২৩৭; রদ্দুল মুহতার ২/২৩৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/৬৫; আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৪; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী ৩৩৬


প্রশ্ন ৫০৪৫: মহিলাদের জন্য যিয়ারতের উদ্দেশ্যে কবরস্থানে যাওয়া জায়েয আছে কি না?

উত্তর:

হাঁ, মহিলাদের জন্য কিছু শর্তসাপেক্ষে কবর যিয়ারত করা জায়েয। তবে নিয়মিত কবরস্থানে না যাওয়াই উত্তম। কেননা মহিলাদেরকে গৃহাভ্যন্তরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে কখনো গেলে নিম্নোক্ত শর্তাদির প্রতি খেয়াল রাখবে।

১. কবরস্থানে গিয়ে কান্নাকাটি, বিলাপ ইত্যাদি করতে পারবে না।

২. পূর্ণ পর্দার সাথে বের হবে।

৩. যাতায়াত নিরাপদ হতে হবে। কোনো প্রকারের গুনাহে পড়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে যাবে না।

-আলবাহরুর রায়েক ২/১৯৫; রদ্দুল মুহতার ২/২৪২; হাশিয়াতুত তহতাবী আলাল মারাকী পৃ. ৩৪০; বযলুল মাজহুদ ১৪/২০৪

 

যানাজা বিষয়ক প্রশ্নের অন্য পর্বগুলির লিঙ্কঃ

যানাজা ও দাফন কাফন সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর পর্ব ০২

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*