মুনাফিকের আলামত

By | Sun 19 Jumada Al Oula 1442AH || 3-Jan-2021AD
একটু যাচাই করি আমি মুনাফিক কী না!!
মুনাফিকুন!
বর্তমানে আমাদের কাফের চেনার চেয়ে বেশি দরকার হলো মুনাফিক চেনা। মুনাফিক শব্দটার অর্থ জীবনের একটা পর্যায়ে এক রকম দ্যেতনা নিয়ে এসেছে। প্রথমভাগে মনে করতাম, তারা মুসলমান তবে একটু দুষ্ট আছে। তারপর মনে হতো: মুনাফিক মানে পাজি ইহুদি। এখন একবার একটা মনে হয়। বেশ কিছু দিন ধরেই ভাবছি, ব্যক্তিগত-সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মুনাফিকের সংজ্ঞার্থ পরিষ্কার করে না জানলে আর চলছে না।
সূরা বাকারা যখন পড়তে বসি, প্রতিবারই বেশ কৌতূহল নিয়ে প্রথম আয়াতক’টা লক্ষ্য করি। প্রথম পাঁচ আয়াতে মুমিনগনের বর্ণনা।
তারপরের (ছয়-সাত) দুই আয়াতে কাফেরদের আলোচনা।
তারপরে (আট-বিশ) বারো আয়াত একটানা মুনাফিকদের আলোচনা।
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। মুনাফিকরা কী এমন হনু হয়ে গেলো, তাদের জন্যে শুরুতেই বারোটা আয়াত বরাদ্দ? কাফেররা কেন ছার, খোদ মুমিনগন পর্যন্ত একপাশে! অবশ্য গুরুত্ব আর গুরুতরতার পার্থক্য বোঝাটাও জরুরী।
নিফাক শব্দটা পুরো কুরআন কারীমে অসংখ্যবার উল্লেখিত হয়েছে। মোট এগারটা সূরায়। এছাড়াও অসংখ্য স্থানে পরোক্ষভাবে উল্লেখিত হয়েছে। এ-থেকেও বিষয়টার গুরুতরতা বোঝা যায়।
নিফাক (نفاق) শব্দটার অর্থ (خروج) বের হওয়া। মুনাফিক যেহেতু ঈমানের গন্ডী থেকে বের হয়ে যায়, তাই তাকে মুনাফিক বলা হয়। অথবা মুনাফিক শব্দটা এসেছে ‘নাফাক’ থেকে। দ্বিমুখী গর্ত। ইঁদুর-খরগোশ জাতীয় প্রাণীদের গর্তের মুখ সাধারণ দুইটা থাকে। একদিক থেকে তাড়া খেলে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে পালায়। মুনাফিকও এমনি। মুনাফিককে বাংলায় কপট বলা হয়। আর নিফাক শব্দের অর্থ ‘কপটতা’। পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয়: যার বাহিরে এক, ভেতরে আরেক।
নিফাক দুই প্রকার:
(এক) আকীদাগত নিফাক। যারা উপরে উপরে মুসলমান পরিচয় দিলেও, ভেতরে ভেতরে নবীজি ﷺ -কে অস্বীকার করে। কুরআনকে অস্বীকার করে। ফিরিশতাদেরকে অস্বীকার করে। মুমিন হওয়ার জন্যে অপরিহার্য আকীদাগুলোতে তারা অস্বীকার করে। এই মুনাফিকরা নিঃসন্দেহে কাফের। তাদের স্থান হবে ‘দারকে আসফালে’। জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।
(দুই) আমলী নেফাক। এদের আকীদা-বিশ্বাস ঠিক থাকবে তবে আমলটা হবে মুনাফিকদের মতো।
মুনাফিকের আলামতসমূহ-
(০১) মিথ্যাচার। একজন মিথ্যা কথা বলবেই। মিথ্যা কথা বলা ‘নিফাকের’ একটা অপরিহার্য অঙ্গ! কুরআন কারীমে যত জায়গায় ‘নিফাকের’ কথা আলোচিত হয়েছে, সাথে সাথে ‘কাযিব’ বা মিথ্যাচারের কথাও উল্লেখিত হয়েছে।
(০২) গাদ্দারী। বিশ্বাসঘাতকতা করা। ওয়াদা ভঙ্গ করা। নবীজি ﷺ বলেছেন:
إذا عاهد غدر
মুনাফিক যখন অঙ্গীকার বা চুক্তি করবে, সে ভঙ্গ করবেই (মুসলিম)।
(০৩) অশ্লীলবাক্য। ঝগড়া-বিবাদ লাগলে, মুনাফিক তার মুখের লাগাম ছেড়ে দেয়। পিচকিরির মতো করে চারদিকে দুর্গন্ধময় বাক্যের তুবড়ি ছোটায়। নবীজি ﷺ বলেছেন:
اذا خاصم فجر
মুনাফিক যখন ঝগড়া করবে, অশ্লীল কথা বলবে (মুসলিম)।
(০৪) ওয়াদাভঙ্গ। মুনাফিকের ধর্মই হলো ওয়াদাভঙ্গ করা।
اذا وعد أخلف
যখন যে ওয়াদা করবে, তা সে ভঙ্গ করবে।
(০৫) ইবাদতে আলস্য। তার ইবাদত করতে ভাল লাগবে না। নামযে মতি হবে না: “আর যখন তারা নামাযে দাড়াবে, অলস হয়ে দাঁড়াবে” (নিসা: ১৪২)।
নামাযের প্রতি উদাসীনতা সৃষ্টি মাধ্যমে শয়তান মানুষের কলবে স্থান করে দেয়। আস্তে আস্তে অন্যদিকে তার কুমন্ত্রণার ঢালপালা ছড়ায়। এটা অনেকটা ডিম পাড়ার মতো। নামাযে অমনোযোগী করে, সে মানুষের মনে গুনাহের ‘ডিম’ পাড়ে। ক্রমে ক্রমে সে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে!
(০৬) লোকদেখানো ইবাদত। সমাজে টিকে থাকতে হবে তো! সমাজে ভালমানুষের পরিচিতি পেতে হবে না! “তারা মানুষকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইবাদত করে” (নিসা: ১৪২)।
হাদীস শরীফেও এমন দেখনেপনা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে:
مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ رَاءَى رَاءَى اللهُ بِهِ
মানুষকে শোনানোর জন্যে, দেখানোর জন্যে ইবাদত করলে, আল্লাহ তার ইবাদতকে মানুষের শোনার ও দেখার ব্যবস্থা করে দেন। আর কোনও বাড়তি প্রতিদান দেন না (বুখারী-মুসলিম)।
(০৭) স্বল্পযিকির। তার মানে মুনাফিকও যিকির করে, তবে অল্প করে। অত্যন্ত বিপদজনক কথা!
ولا يذكرون الله الا قليلا
তারা খুব অল্পই আল্লাহর যিকির করে (নিসা: ১৪২)।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলছেন, তারা যিকির করলেও অল্প করে। কারন তাদের কলব মরে গেছে। যিকিরে স্বাদ পায় না। দায়সারা গোছের যিকির করেই দায়িত্ব সারে! টেরও পায় না, তাদের কাজটা মুনাফিকসুলভ হয়ে যাচ্ছে!
(০৮) ঠোকরানো-নামায। দুনিয়ার সব কাজের সময় থাকে। অফুরান অবসর থাকে। ক্লান্তিহীন ফুরসত মেলে, মাগার নামাযের জন্যে পাঁচটা মিনিট বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়!
تلك صلاة المنافق، يرقب الشمس حتى تدنو من الغروب) ثم يقوم فينقر أربع ركعات
মুনাফিকের নামায? সে সূর্য ডোবার সময় হওয়ার প্রতীক্ষায় থাকে। আরেকটু পরে পড়বে, এই আশায়। সুর্য যখন ডুবি ডুবি করে, সে (মোবাইল-ল্যাপটপ-বই-আড্ডা-টিভি-খেলা রেখে) তড়াক করে ওঠে পাখির ঠোকর মারার মতো দুমদাম সিজদা মেরে চার রাকাত শেষ করে! (তিরমিযী)।
(০৯) ছিদ্রান্বেষণ। সে কটাক্ষ করে। মুমিনগন দান করলে, খয়রাত করলে, সাদাকা করলে তার গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। থাকতে না পেরে ঠেস মেরে কথা বলে: “যারা স্বেচ্ছায় দানকারীদেরকে কটাক্ষ করে” (তাওবা ৭৯)।
(১০) উপহাস। মুনাফিকদের উপহাসের আওতায় সবকিছুই থাখে; কুরআন কারীম, হাদীস শরীফ, পেয়ার নবী ﷺ:
আপনি বলুন: তোমরা কি আল্লাহ ও তার নিদর্শনাবলী ও তার রাসূলকেই উপহাস করছো? (তাওবা: ৬৫)।
এটা সুস্পষ্ট কুফুরি। পরের আয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা সেটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন। আরেক আয়াতে আল্লাহ মুনাফিকদের সাথে ওঠাবসা করতেও নিষেধ করেছেন।
(১১) মিথ্যাশপথ। কথায় কথায় ‘খোদার কসম’ বলে ফেলবে। অবিশ্বাস করার কোনও উপায় রাখবে না। আল্লাহর নামকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না:
“তারা তাদের শপথকে বাঁচার জন্যে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করেছে” (মুজাদালাহ: ১৬)।
(১২) কষ্টকল্পিত ব্যয়। একটা টাকা পকেট থেকে বের করতেই জান বেরিয়ে যায়। তবুও সভাপতি বানিয়ে দিয়েছে, সম্পাদক করেছে না দিয়ে উপায় আছে! কিন্তু:
আর তারা প্রচন্ড অনীহা নিয়ে না পারতে খরচ করে (তাওবা: ৫৪০।
(১৩) তাখযীল (التخذيل)। মানুষকে জিহাদ ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করা। নানা মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে মূলবাহিনী থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করা। পিছু টেনে ধরে রাখার প্রয়াস চালানো। উদ্যম ও সাহসহীন করে তোলা। তাবুক যুদ্ধের সময় এমনটা হয়েছিল:
وَقَالُوا لَا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ
উফ! এই অসহ্য গরমে যুদ্ধে বের হয়ো না (তাওবা: ৮১)।
(১৪) ইরজাফ। সমাজে বা ময়দানে গুজব রটিয়ে বেড়ানো। মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার অপপ্রয়াস চালানো:
মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে, এবং যারা নগরে গুজব রটিয়ে বেড়ায়, তারা যদি এসব থেকে বিরত না হয়, তবে আমি অবশ্যই এমন করবো যে, তুমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ফলে তারা এ নগরে তোমার সাথে অল্প কিছুদিনই অবস্থান করতে পারবে (তাওবা: ৬০)।
(১৫) তাকদীরের প্রতি আপত্তি। মুনাফিকরা তো আসলে কিছুর প্রতিই ঈমান রাখে না। তাকদীরের প্রতিও না। সবকিছু আল্লাহই করেন, এই বিশ্বাস তারা পোষণ করে না:
“যারা যুদ্ধে না গিয়ে, ঘরে বসে থেকে থেকে বলে: তারা যদি আমাদের কথা মানতো, তাহলে তারা যুদ্ধে নিহত হতো না” (আলে ইমরান: ১৬৮)।
(১৬) মানহানি। মুনাফিকদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তারা নেককার মুমিনগনের সম্মানহানি ঘটায়। তাদের নামে নানা অপবাদ রটায়। উপহাস আর অপবাদ এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন জিনিস:
অতঃপর যখন ভয় কেটে যায়, তখন তারা তীক্ষ্ণ ভাষায় তোমাদেরকে বিদ্ধ করে (আহযাব: ১৯)।
(১৭) জামাতত্যাগ। ঘরের কাছে মসজিদ থাকতেও, ঘরে নামায পড়া। উম্মাহ মারাত্মকভাবে এ-রোগে আক্রান্ত। এ-এক দুরারোগ্য ব্যাধি:
وما يتخلف عنها إلا منافق معلوم النفاق
জামাত থেকে পির্ছিয়ে থাকে একমাত্র সুস্পষ্ট নিফাকের অধিকারী মুনাফিকরা (মুসলিম)।
(১৮) ফাসাদসৃষ্টি। মুনাফিকরা মনে করে তারা ভাল কাজই করছে,বাস্তবে সেটা সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। তারা সমাজ সংশোধনের জন্যেই কাজগুলো করে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো সমাজে বিশৃঙ্খলার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়:
وإذا قيل لهم لا تفسدوا في الأرض قالوا إنما نحن مصلحون ألا إنهم هم المفسدون ولكن لا يشعرون
যখন তাদেরকে বলা হয়: যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা বলে আমরা তো সংশোধনকারী। সাবধান! তারাই ফাসাদসৃষ্টিকারী কিন্তু তারা টের পায় না (বাকারা: ১১-১২)।
(১৯) ভেতরে এক বাহিরে আরেক। এটাই মুনাফিকদের মূল বৈশিষ্ট্য। তারা বাইরে প্রকাশ করে এক কথা, ভেতরে পুষে রাখে আরেক কথা:
إذا جاءك المنافقون قالوا نشهد إنك لرسول الله والله يعلم إنك لرسوله والله يشهد إن المنافقين لكاذبون
মুনাফিকরা যখন আপনার কাছে আসে, তারা বলে: আমরা স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ জানেন আপনি অবশ্যই আল্লাহর রাসুল। আল্লাহ স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন নিশ্চয় মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী (মুনাফিকুন: ১)।
(২০) সার্বক্ষণিক ভয়। কখন জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়! এই বুঝি সবাই তার মনের কথা জেনে গেলো! এই বুঝি সবাই তার দিকে ধেয়ে এলো রে!
يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَن تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُم بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ
মুনাফিকরা ভয় পায়, পাছে মুসলিমদের প্রতি কোনও সূরা নাযিল হয়ে যায়, যা তাদের (মুনাফিকদের) মনের কথা জানিয়ে দেবে (তাওবা: ৬৪)
(২১) মিথ্যা অযুহাত। সে যুদ্ধে অংশ নেয়নি ভীরুতা ও নিফাকির কারণে, কিন্তু নেতার কাছে এসে অজুহাত দেখাবে শরীর খারাপ। অর্থিক সমস্যা। মা-বাবার অনুমতি নেই। বিবি-বাচ্চার অসুখ:
يَعْتَذِرُونَ إِلَيْكُمْ إِذَا رَجَعْتُمْ إِلَيْهِمْ
আপনি যখন (তাবুক থেকে) ফিরে আসবেন, তারা আপনার কাছে এসে (মিথ্যা) অজুহাত পেশ করবে (তাওবা: ৯৪)।
(২২) মন্দকাজের আদেশ, সৎ কাজের নিষেধ। মুনাফিকদের কাজের ধরনই উল্টো। শরীয়ত বলে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে, তারা মানুষকে ভালো কাজে নিরুৎসাহিত করে। আবার মন্দ কাজে ঠিকই উৎসাহ যোগায়:
يأمرون بالمنكر وينهون عن المعروف
তারা মন্দকাজে আদেশ করে, ভালকাজের বেলায় নিষেধ করে (তাওবা: ৬৭)।
(২৩) জিহাদে বাধাপ্রদান। মুনাফিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেরাও জিহাদে যাবে না, অন্যদেরকে যেতে বাধা সৃষ্টি করবে। নানা লোভ-প্রলোভনে বেঁধে রাখার চেষ্টা করবে:
قَدْ يَعْلَمُ اللَّهُ الْمُعَوِّقِينَ مِنكُمْ وَالْقَائِلِينَ لِإِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ إِلَيْنَا
আল্লাহ তাদেরকে ভাল করেই জানেন, তোমাদের মধ্যে যারা (জিহাদে) বাধাপ্রদান সৃষ্টি করে এবং নিজ ভাইদেরকে বলে, তোমারা আমাদের কাছে চলে এসো। (জিহাদ করে কী হবে?) তাওবা: ১৮।
(২৪) কৃপণতা ও অর্থলোভ। ইহুদিদের মতো তাদের হাত গলে পানি পড়ারও উপায় নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ – أَشِحَّةً عَلَى الْخَيْرِ
তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে না, করলেও সেটা করে তোমাদের প্রতি লালায়িত হয়ে নামকাওয়াস্তে অংশগ্রহন করে, তাহলে তোমরা তাদেরকে কিছু গনীমত দিবে। তারা সম্পদের প্রতি তীব্রভাবে লোলুপ হয়ে তোমাদেরকে গালিগালাজও করতেও ছাড়ে না (তাওবা: ১৯)।
(২৫) আল্লাহকে ভুলে যাওয়া। মুনাফিকরা সবকিছু স্মরণ করে, মনে রাখে, শুধু আল্লাহর কথা তাদের মনে থাকে না। গানের কথা মনে থাকে। খেলার কথা মনে থাকে। পরিবারের কথা মনে থাকে। চাকুরির কথা মনে থাকে। ব্যাংক-ব্যালেন্সের কথা মনে থাকে, শুধু আল্লাহর কথাই তাদের মনে থাকে না: “তারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, আল্লাহও তাদেরকে ভুলে গেছেন” (তাওবা: ৬৭)।
(২৬) আল্লাহ ও তার রাসূলের দেয়া ওয়াদা-প্রতিশ্রুতিকে অস্বীকার করা। প্রত্যাখ্যান করা। সেগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্যে উঠেপড়ে লাগা।
(২৭) বাহ্যিক ঠাঁটবাটকে গুরুত্ব দেয়া, ভেতরটাকে অবহেলা করা। পোশাক-আশাক দেখলে মনে হয়, বিরাট কিছু, কিন্তু কথা বলার পর হাকীকত উদোম হয়ে পড়ে!
“তুমি যখন তাদেরকে দেখো, তখন তাদের দেহাকৃতি তোমাকে মুগ্ধ করে।” (মুনাফিকুন: ৪)।
গায়ে-গতরে তারা বেশ ঝাঁকালো, কথাবার্তায়ও তাদের বেশ চোটপাট! কিন্তু একটু পরেই সব ফাঁস হয়ে পড়ে! দৈন্যদশা প্রকাশ পায়।
(২৮) ভেতরে যাই থাকুক, তাদের চাপার জোর দেখলে মনে হবে, একেকজন রাজা-উযীর। কৃত্রিম বাগ্মিতা, অহংকারপূর্ণ বাগাড়ম্বর, গালভরা বুলি দিয়ে আশপাশকে বেশ মোহিত করে রাখতে পারে:
“আর তারা যখন কথা বলে, তুমি তাদের কথা শুনতে থাকো, তারা যেন ঠেকনা দেয়া কাঠ।” (মুনাফিকুন: ৪)।
(২৯) বোধবুদ্ধিহীনতা। মুনাফিকরা যতই নিজের জাহির করার চেষ্টা করুক, বাস্তবে তাদের ঘটে খুব বেশি বুদ্ধি নেই। যে আল্লাহকে চিনতে পারলো না, রাসূলের আদর্শকে ধারন করতে পারলো না, সে কী করে বুদ্ধিমান হতে পারে?
“কিন্তু মুনাফিকরা কিছু বোঝে না” (মুনাফিকুন: ৭)।
দ্বীন সম্পর্কে মুনাফিকদের ন্যূনতম জ্ঞানও নেই। থাকলে কি তারা এমন হোঁচট খায়?
(৩০) মুনাফিকরা আল্লাহর নাফরমানি করার ক্ষেত্রে, আল্লাহকে শরমায় না, মানুষকে শরমায়:
يستخفون من الناس ولا يستخفون من الله وهو معهم اذ يبيتون ما لا يرضى من القول
তারা মানুষকে তো শরমায় কিন্তু আল্লাহকে শরমায় না। অথচ রাতের বেলায় তারা যখন আল্লাহর অপছন্দনীয় কথা বলে, তখন তিনি তাদের সাথেই থাকেন (নিসা: ১০৮)।
(৩১) মুনাফিকরা সব সময়ই মুমিনের অকল্যাণ কামনা করে। ক্ষতিসাধন করতে চায় মনে মনে। মুমিনের আরাম তাকে ব্যারামে ফেলে দেয়:
إن تصبك حسنة تسؤهم وإن تصبك مصيبة يقولوا قد أخذنا أمرنا من قبل
আপনার কোনও কল্যাণ লাভ হলে তাদের দুঃখ হয়,আর যদি আপনার কোনও মুসীবত দেখা দেয়, তখন তারা বলে, আমরা তো আগেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম, আর একথা বলে তারা বড় খুশী মনে সটকে পড়ে (তাওবা: ৫০)।
(৩২) মুনাফিকের আরেকটি বিখ্যাত ও সুপরিচিত বৈশিষ্ট্য হলো:
اذا أؤتمن خان
তার কাছে আমানত রাখা হলে সে খেয়ানত করবে।
(৩৩) তাদের অন্তরটা কু-লালসাপূর্ণ।
يَٰنِسَاءَ ٱلنَّبِىِّ لَسْتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ ٱلنِّسَاءِ إِنِ ٱتَّقَيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِٱلْقَوْلِ فَيَطْمَعَ ٱلَّذِى فِى قَلْبِهِۦ مَرَضٌ
হে নবী পত্নীগন! তোমারা সাধারন নারীগণের মতো নও। যদি তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো, তাহলে তোমরা কোমল কণ্ঠে কথা বলো না, পাছে অন্তরে ব্যাধি আছে এমন ব্যক্তি লালায়িত হয়ে পড়ে (আহযাব: ৩২)।
(৩৪) তারা আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা করবে, সুধারনা রাখবে না:
“আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদেরকে আযাব দিবেন, তারা আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা পোষণকারী” (ফাতহ: ৬)।
(৩৫) হিংসাত্মক গোপন কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে, মসজিদ নাম দিয়ে বা অন্য কোনও নামে আলাদা কেন্দ্র খুলে বসবে। বৈধতার জন্যে সর্বজনমান্য কাউকে দিয়ে উদ্বোধনও করাবে:
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مَسْجِدًا ضِرَارًا وَكُفْرًا وَتَفْرِيقًا بَيْنَ الْمُؤْمِنِينَ وَإِرْصَادًا لِّمَنْ حَارَبَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ مِن قَبْلُ ۚ وَلَيَحْلِفُنَّ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا الْحُسْنَى وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ
আর কিছু লোক এমন, যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে এই উদ্দেশ্যে যে, তারা (মুসলিমদের) ক্ষতি সাধন করবে, কুফুরি কথাবার্তা বলবে, মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে, আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারীর জন্যে ঘাঁটির ব্যবস্থা করবে (তাওবা: ১০৭)।
(৩৬) মুমিনগনকে বাদ দিয়ে, কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাবে। মুমিনগনের বিরুদ্ধে কাফিরদেরকে সাহায্য করবে। মুমিনগনকে হত্যার জন্যে ওঁত পেতে থাকবে। নিসা: ১৩৮-৩৯। নিসা ১৪১।
(৩৭) আহলে কিতাব মানে ইহুদি-নাসারার সাথে বন্ধুত্ব পাতানো। মুমিনগনের বিরুদ্ধে তাদের সাথে চুক্তি করা।
لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ
তোমরা ইহুদি-নাসারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না (মায়িদা: ৫১)।
(৩৮) ঈমান ও কুফুরের মাঝে তারা টলটলায়মান থাকবে। এদিকেও যাবে না, আবার পুরোপুরি ওদিকেও যাবে না। দোদুল্যমান অবস্থাতেই জীবন পার করে দিবে (নিসা: ১৪৩)।
(৩৯) তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হবে। জাগতিক আইনের প্রতি আস্থাশীল হবে। আল্লাহর দেয়া বিধানের প্রতি উদাসীন থাকবে (নিসা: ৬০-৬১)।
(৪০) মুমিনগনের মাঝে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অনবরত চেষ্টা করে যাবে। প্রয়াস চালিয়ে যাবে। এবং মুসলামানদের বিভক্তি থেকে তারা সুযোগ সন্ধান করে বেড়াবে। চেষ্টা চালাবে কিভাবে এই বিভক্তি আরও বৃদ্ধি করা যায় (তাওবা: ৪৭-৫০)।
(৪১) আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করবে। শপথ করে বলবে, তারাও মুসলমান। অথচ মুসলমানদেরকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করবে। বারবার মুসলমানদের গন্ডীর বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে ( তাওবা: ৫৬)।
(৪২) জিহাদ ও পরিশ্রমের কাজে সব সময় পেছনের সারিতে থাকতে পছন্দ করবে (তাওবা: ৮৭)।
(৪৩) তারা সুযোগ পেলেই পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে শলা-পরামর্শ করতে বসে যাবে। অনেক সময় মুমিনগনকে দেখিয়ে দেখিয়েও তারা ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলবে (মুজাদালাহ: ১০)।
(৪৪) মুনাফিকদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। তারা যতদিন এই ব্যধি থেকে মুক্ত না হবে, ততদিন পর্যন্ত শয়তান মুনাফিকদের অন্তরকে বক্র করে রাখে। সেখানে কুরআন কারীমের শিক্ষা পশতে পারে না। তারা কুরআন কারীম শুনলেও সেটাতে তারা উল্টো অর্থ গ্রহণ করে (হজ্জ: ৫৩)।
(৪৫) তারা মুমিনগনকে নিবোধ মনে করবে। নিজেদেরকে বুদ্ধিমান মনে করবে (বাকারা: ১৩)।
(৪৬) সত্য প্রকাশ পেলেও তারা পাপের অহমিকা তাকে পেয়ে বসবে। সে হক গ্রহণ না করার ব্যাপারে গোঁ ধরে থাকবে (বাকারা: ২০৬)।
(৪৭) তারা সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকে। কখন মুমিনগনের জয় হয়। তাহলে তারা গনীমত লাভ করার জন্যে তদ্বির করে, আর যদি কাফিররা জয়লাভ করে, তাহলে তারা ও পক্ষ থেকে সুবিধা লাভের প্রয়াস চালায় (নিসা ১৪০-৪১)।
(৪৮) তারা তো কখনোই যুদ্ধে যেতে চায় না। বাধ্য হয়ে গেলেও, কিছুক্ষণ পরই তারা ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করে দেয় (হাশর: ১১)।
(৪৯) ভাল কথা শুনবে কিন্তু সে কথা তাদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছবে না। মানা তো দূরের কথা (মুহাম্মাদ ১৬)।
(৫০) আল্লাহর দ্বীন প্রচারের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিবে (নিসা: ৬০-৬১)।
(৫২) জিহাদের কথা শুনলেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করবে। তাদের চোখেমুখে তীব্র ভয়ের ছাপ ফুটে উঠবে। শুধু জিহাদের ময়দানে যাওয়াই নয়, নিছক জিহাদের আলাপেও তারা ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়বে (মুহাম্মাদ ২০)।
(৫২) টাকা দিলে খুশি থাকবে, না দিলে বেজায় চটে যাবে। পুরো স্বার্থান্ধ থাকবে (তাওবা: ৫৮)।
(৫৩) তারা আত্মীয়তার বন্ধন ঠিকমতো রক্ষা করে না। ক্ষেত্রবিশেষে ছিন্ন করে (মুহাম্মাদ:২২)।
(৫৪) কিছু কিছু ব্যাপারে তারা সরাসরি কাফেরদের অনুসরন করবে (মুহাম্মাদ:২৬)।
(৫৫) আল্লাহ যা অপছন্দ করেন, সেটাই তারা অনুসরন করে। আল্লাহর সন্তুষ্টিকে তারা অপছন্দ করে (মুহাম্মাদ: ২৮)।
(৫৬) তাদের মনে প্রচন্ড বিদ্বেষ থাকবে। নিজেদের বিদ্বেষাণলে নিজেরাই ধিকিধিকি জ্বলতে থাকবে (মুহাম্মাদ: ২৯)।
(৫৭) তাদের নির্দিষ্ট কিছু আলামত থাকবে। তাদের কথার ভঙ্গিও আলাদা হবে। খেয়াল করলে তাদের কথার বিশেষ ভঙ্গি দিয়েই তাদেরকে চিনে ফেলা যাবে (মুহাম্মাদ: ২৯)।
(৫৮) তারা মুমিনদের সাথে জিহাদে বের হওয়া থেকে পিছিয়ে থাকবে (নিসা: ৭২)।
(৫৯) কুরআন কারীম তাদের কোনও উপকারে আসবে না। বরং তাদের অন্তরের অপবিত্রতাই বাড়িয়ে দেবে। তারা কাফের অবস্থাতেই মারা যাবে (তাওবা: ১২৪)।
(৬০) যা করতে নিষেধ করা হবে, তা বারবার করবে। দূরে সরিয়ে দিলে আবার ফিরে আসবে (মুজাদালাহ: ৮)।
(৬১) জিহাদে বের হওয়াকে ফিতনা মনে করবে। নেতার কাছে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি চাইবে (তাওবা: ৪৯)।
(৬২) তারা সমাজে অশ্লীল কথা ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করবে। সম্মানিত লোকদের সম্পর্কে (নূর: ১৯)।
আপাতত এখানেই থামা যাক। আস্তে আস্তে সংযোজন হতে থাকবে। ইনশাআল্লাহ।
– Sayekh Atik Ullah Hafijahullah
Facebooktwitterredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*