উম্মাহর নক্ষত্ররাজি : মুসআব ইবনে উমাইর (রাযিআল্লাহু আনহু)

By | Sun 8 Rabi Al Awwal 1442AH || 25-Oct-2020AD
নাম: মুসআব, কুনিয়াত আবু মুহাম্মদ। ইসলাম গ্রহণের পর লকব হয় মুসআব আল-খায়ের।
পিতা ’উমাইর এবং মাতা খুনাস বিনতু মালিক।

মক্কার প্রখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুসআব ইবনে উমাইর। সমস্ত আরব অঞ্চলে যে সকল পরিবার সম্পদ ও বিত্তের দিক থেকে শীর্ষে ছিল, মুসআবের পরিবার ছিল তাদেরই একটি। বিপুল প্রাচুর্য আর বিলাসিতার মধ্য দিয়ে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল। তিনি ছিলেন ধনী বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ভীষন আদর আর যত্নে তারা তাদের সন্তানকে বড় করছিলেন। আরব অঞ্চলের সকলের চেয়ে দামী জামা তিনি পরতেন। সে সময়কার সবচেয়ে স্টাইলিশ জুতা থাকতো তাঁর পায়ে। তখনকার যুগে ইয়ামেনী জুতা ছিল সারা বিশ্বে বিখ্যাত। আর মুসআবের পায়ে থাকত ইয়ামেনী জুতার মধ্যেও সবচেয়ে দামী জোড়াটি। মোটকথা তৎকালীন আরবে যত ধরনের দামী চমকপ্রদ পোষাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে কোনভাবে তার প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলতেন, “মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোষাকধারী আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিকেরা বলেছেনঃ “তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারি।”
তিনি দেখতে ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন ও সুপুরুষ। শুধুমাত্র ফ্যাশন এবং সৌন্দর্যের জন্য নয়, বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার জন্যও তিনি ছিলেন তৎকালীন কুরাইশ সমাজের মধ্যে বিখ্যাত একজন। তাঁর এ সকল গুণাবলীর জন্য তিনি মক্কার মানুষদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন, এবং অবিবাহিত পুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম পছন্দের তালিকায়। বয়সে তরুণ হওয়া সত্ত্বেও কুরাইশদের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও সমাবেশে তাঁর প্রবেশাধীকার ছিল। আর সেজন্যেই তিনি ছিলেন এমন একটি অবস্থানে, যে মক্কার মানুষ এবং কুরাইশদের পরিকল্পনা এবং মনোভাব সম্বন্ধে জানতেন।
একদিন হঠাৎ মক্কার মানুষদের মধ্যে একটি বিস্ময়কর খবর রটে গেল যে, মুহাম্মাদ নামের একজন বিশ্বস্ত কুরাইশ, যিনি আল আমিন বা একমাত্র বিশ্বাসী হিসাবে সবার কাছে পরিচিত, নিজেকে আল্লাহ্’র নাবী বলছে এবং এ কথাও বলছে যে তাঁকে দ্বীনে হক্ব-সত্য দ্বীন সহ সতর্ককারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে। তিনি কুরাইশদের ডেকে বলেছেন-আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন রব্ব নেই সুতরাং আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো সার্বভৌমত্ব মেনে নিলে কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে সবার জন্য এবং যারা আল্লাহ কে একমাত্র ইলাহ্ হিসাবে মেনে নিয়ে আর সবকিছুর দাসত্ব ও আনুগত্য ত্যাগ করবে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে মহাপুরস্কার। মক্কার সমস্ত মানুষের উত্তপ্ত আলোচনার বিষয়ে পরিণত হলো মুহাম্মাদের এ অদ্ভুত দাবীর খবর। কুরাইশদের মধ্যে দায়িত্বশীলরা জরুরী পরামর্শ সভায় বসে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করল। যখন তারা দেখল মুখে বলে এবং বিদ্রুপ করে এর কোন বিহিত হচ্ছেনা, তখন তারা অত্যাচার এবং প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
নতুন এই মতবাদ মুসআবের কানেও এসেছিল। তিনি বিষয়টি নিয়ে তলিয়ে দেখবেন বলে ভাবলেন। ইতিমধ্যেই তিনি খবর পেলেন মুহাম্মাদ এবং তাঁর সঙ্গীরা কুরাইশদের অত্যাচার থেকে বেঁচে আলোচনা করার জন্য মক্কার উপকন্ঠে আরকাম নামের একজন বিশ্বস্ত সঙ্গীর বাড়ীতে মিলিত হচ্ছেন। এই হলো সেই বিখ্যাত দারুল আরকাম বা আরকামের গৃহ, যেখান থেকে রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গোপনে ইসলাম প্রচার করেছিলেন এবং মিলিত হচ্ছিলেন তাঁর সাহাবীদের সাথে। কৌতুহলী মুসআব তাঁর কৌতুহল মেটাবার জন্য এ বাড়ীটিতে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
মক্কার আকাশ হতে সূর্য বিদায় নিয়েছে, রাতের অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে দিনের আলোকে। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। কুরাইশদের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচার জন্য মুসআব অত্যন্ত গোপনে চললেন দারুল আরকামের দিকে। উদ্দেশ্য মুহাম্মাদ ও তাঁর সত্য দ্বীনের অনুসারী ও অনুসন্ধানীরা কী করে তা স্বচক্ষে দেখা। ধীর পায়ে, বুকে অজানা এক শঙ্কা নিয়ে মুসআব পৌঁছে গেলেন সেখানে।
মুসআব এমন এক বরকতময় সন্ধায় সেখানে উপস্থিত হলেন যে, তিনি দারুল আরকামে উপস্থিত হতে না হতেই রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর নতুন ওহী নাযিল হলো। তিনি দেখলেন, আল্লাহ্’র রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই ওহীখানা তিলাওয়াত করে উপস্থিত সকলকে শুনালেন। উপস্থিত সকল শ্রোতার অন্তরে যেন সেই ওহীর মর্মবাণী তৎক্ষণাত পৌঁছে গেল। সুবহানাল্লাহ্! কী বরকতময় বৈঠক ছিল সেটি, যেখানে লোকজন স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের মোবারক জবান হতে আল্লাহর নাযিলকৃত ওহীর তিলাওয়াত শুনছে। এমন বরকতময় বৈঠকের শ্রোতা হতে পেরে মুসআব নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতেই পারেন! তিলাওয়াতকৃত কুরআনের বানীর সুতীব্র আকর্ষণ মুসআবের দেহ-মন-প্রাণ কে ভীষণভাবে আন্দোলিত করলো। মহাসত্য গ্রহণের আকাঙ্খায় তাঁর অন্তর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। জাহিলিয়্যাতের নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে তিনি দ্বীনে হক্বের স্পষ্ট ও তীব্র আলোর ঝলকানি দেখতে পেলেন। সুস্পষ্ট হক্বেও সন্ধান পেয়ে মুহূর্তেই তিনি হয়ে গেলেন এক পবিত্র বিশ্বাসী অন্তরের অধিকারী।
ইতিমধ্যে মুসআব রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে এসে পড়েছেন। তিনি মুসআবকে স্বাগত জানালেন এবং তাঁর একটি বরকতময় পবিত্র হাত মুসআবের বুকের ওপর রাখলেন। মুসআব যেন দারুন এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়লেন। মুসআবের অন্তর ভীষণ উত্তেজনায় আপ্লুত হল। এক গভীর অনুভূতি আর জান্নাতী আবেশে তাঁর হৃদয় ছেয়ে গেল। যা দেখেছেন এবং শুনেছেন তার আবেশে তিনি আবিষ্ট ছিলেন। কুরআনের বাণী তাঁর মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি ঈমান ও ইসলামের ঘোষণা দিলেন। আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসআবের জন্য দুআ করলেন। এ ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যে দুআর বরকতে মক্কার ধনীর দুলাল তার বয়সের তুলনায় আরও অধিক হিকমাহ্ ও প্রজ্ঞার অধিকারী হয়ে গেল।
যার প্রমাণ হিসেবে আমরা তাঁর জীবনের পরবর্তী অংশে দেখতে পাই ঈমানের পরীক্ষায় তিনি এতটাই দৃঢ় ও অটল ছিলেন যে, শত অন্যায়-যুলুমও তাকে ঈমান ও ইসলামের পথ থেকে ক্ষণিকের জন্যও বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। মূলতঃ একজন মানুষ যখন আল্লাহকেই একমাত্র রব্ব-সার্বভৌম মালিক মেনে ঈমান আনে থখন তার জীবনে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা আসতে বাধ্য। কারণ একজন মানুষকে আল্লাহ্ পাক সৃষ্টিই করেছেন একমাত্র তাঁর দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা করার জন্য। কিন্তু এ জন্য তিনি মানুষকে বাধ্য না করে স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন উপায়ে পরীক্ষা করে দেখতে চান এই স্বাধীণতা পেয়ে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় কি-না? ঈমান ও ইসলাম ত্যাগ করে শিরক ও কুফর গ্রহণ করে নি-না? আমরা মুসআব-এর ক্ষেত্রে দেখতে পাই আল্লাহর পক্ষ হতে মুসআবের জীবনে বিভিন্নভাবে ঈমানের চরম পরীক্ষা এসেছে- কখনো সম্পদের ভয-ভীতির মাধ্যমে, কখনো আত্মীয়তার সম্পর্কের মাধ্যমে, কখনো যুদ্ধেও ময়দানে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ্! সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ্! জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছেন। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে- মুসআবের প্রখর মেধা, আন্তরিক ব্যবহার এবং একাগ্রতা এমনভাবে ইসলামের জন্য নিবেদিত হয়েছিল যা মানব ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিয়েছিল।
ঈমান ও ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসআবের অন্তরে পূর্বের জীবনের সকল কেব-দেবীদের সম্পর্কে এক প্রচন্ড ঘৃণাবোধ তৈরী হয়েছিল। কুরাইশদের সকল প্রকার বিরোধীতার ভয় তাঁর অন্তর হতে মুছে গিয়েছিল। ইসলাম গ্রহণের ফলে মক্কার সমস্ত যায়গা থেকে তিনি পদচ্যুত হবেন, অন্যান্য মুসলিমদের মতো কঠিন অত্যাচার নেমে আসবে তাঁর উপর-এ চিন্তাও তাঁর মনে কোন প্রভাব ফেলেনি। মোট কথা পৃথিবীর সকল কিছুর ভয় তার অন্তর হতে দূর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর মাকে নিয়ে মুসআবের ভয় কোনভাবেই দূর হচ্ছিল না। কারণ তাঁর মা খুনাইস বিনতে মালিক ছিলেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ় মনোবলের অধীকারী, সম্ভ্রান্ত বংশীয় আরব মহিলা। তিনি ছিলেন নির্ভীক এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী। এছাড়াও নিজ বাতিল দ্বীনের প্রতি দৃঢ় অবস্থানের কারণে ছেলের এ দ্বীন পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি কিছুতেই মেনে নিবেন না। কিন্তু মা’কে প্রতিপক্ষ হিসাবে নেয়ার ব্যাপারটা তিনি সহজ মনে করলেন না। মুসআব দ্রুত চিন্তা করলেন। তিনি তাই মনে মনে সংকল্প করলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে চূড়ান্ত ফায়সালা না আসা পর্যন্ত অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত না আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর এ ইসলাম গ্রহণের সংবাদ প্রকাশ না করে দেন ততদিন পর্যন্ত তিনি নিজ থেকে মায়ের নিকট ইসলাম গ্রহণের এ খবর গোপন রাখবেন।
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সান্নিধ্যে থেকে তিনি দ্বীন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান আহরণের জন্য দারুল আরকামে তার নিয়মিত গোপন যাতায়াত আগের মতই অব্যাহত রাখলেন। ঘরে ফিরে এসে তিনি থাকতেন আগের মতই, যার ফলে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা তাঁর মা জানতে পারলেন না। কিন্তু আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় এ অবস্থা বেশীদিন চললো না। কারণ সে সময়টা মক্কায় এমন ছিল, যখন কোন খবর মক্কাবাসীদের কাছ থেকে বেশীদিন গোপন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কুরাইশদের চোখ আর কান যেন মক্কার অলিতে গলিতে লাগানো ছিল। মক্কার মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজ করত একদল শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী। ইতিমধ্যে দারুল আরকামে মুসআবের নিভৃত যাতায়াত উসমান ইবনে তালহা নামের এমনই একজন গোয়েন্দার নজরে পড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে উসমান ইবনে তালহা মুসআবকে অনুসরণ করতে শুরু করেন এবং একদিন তিনি লক্ষ্য করেন যে, মুহাম্মাদের অন্য সকল অনুসারীদের মাঝে মুসআবও দারুল আরকামে বসে তার ওহীভিত্তিক আলোচনা শুনছে। অতঃপর আরেকদিন উসমান ইবনে তালহা দেখতে পেল যে, মুসআব ঠিক সেভাবেই প্রার্থনা (সালাত) করছেন যেভাবে মুহাম্মাদ করে থাকেন। তার নিকট এ ছিল মুসআবের ইসলাম গ্রহণ করার সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সুতরাং মুসআব যে ইসলাম গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে তার মনে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ রইলো না। মরুঝড় যেভাবে প্রচন্ডগতিতে বয়ে যায়, মুসআবের ইসলাম গ্রহণের খবর তেমনি মুহূর্তের মধ্যে মক্কার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিলো উসমান ইবনে তালহা।
সবার মুখে মুখে আলোচিত বিষয় তখন একটিই- মক্কার ধনীর দুলাল মুসআব মুহাম্মদের দাওয়াত কবুল করেছে অর্থাৎ মুহাম্মদের প্রচারকৃত সত্য দ্বীন-আল ইসলাম গ্রহণ করেছে। মুসআব যে বিষয়টিকে এতদিন চেপে রেখেছিলেন মায়ের ভয়ে তা অবশেষে এক কান, দু’ কান করে তাঁর মায়ের কান অব্দি পৌঁছে গেল। তিনি একে আল্লাহ পাকের সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নিয়ে মায়ের সম্মুখে দাঁড়ানোর জন্য আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করে মানসিকভাবে তৈরী হয়েই রইলেন। তার মা এ সংবাদ শুনা মাত্রই কুরাইশ সহ মক্কার সকল গোত্রের নেতৃবৃদকে ডেকে পাঠালেন তার বাড়ীতে। উদ্দেশ্য মুসআবের দ্বীন পরিবর্তনের বিষয়ে বিচার-ফায়সালা করা।
মক্কার কুরাইশ নেতৃত্ব মুসআবের খোঁজে বের হল। এক সময় তারা সকলে এসে জমায়েত হল তাঁর বাড়ীতে। তারা জানতে চাইছিল মুসআবের ইসলাম গ্রহণের খবর আদৌ সত্য কিনা এবং কেন সে এমন সমাজবিরোধী সিদ্ধান্ত নিল? মুসআব ধীরে ধীরে এদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
আল্লাহ্ পাক মুসআবকে দৃঢ়তা দান করলেন, তাঁর অন্তর হতে সকল প্রকার ভয়-ভীতি দূর করে দিলেন। ফলে এই চরম সংকট মুহূর্তেও সত্য প্রকাশে কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্দ তাঁর অন্তরে স্থান পেল না। কারণ যারাই আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালাকে একমাত্র রব্ব মেনে রব্বুনাল্লাহু ঘোষণা করেছে এবং এ ঘোষণার উপর দৃঢ় থেকেছে তাদেরতো আসলে কোন ভয়-ভীতি-সংকোচ থাকতে পারে না। ঈমানদার ব্যক্তি কখনোই এহেন পরিস্থিতিতে নিঃসঙ্গতা বোধ করে না, কারণ সে সর্বক্ষণই তাঁর অন্তর দ্বারা চারপাশের সাহায্যকারী ফিরিশতাদের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারে। তাই তিনি বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ না করে প্রশান্ত চিত্তে এবং অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, আপনারা যা শুনেছেন তা সত্য, হ্যাঁ, আমি ঈমান ও ইসলাম গ্রহন করেছি। তিনি কেন ঈমান ও ইসলাম গ্রহন করেছেন তাও ব্যাখ্যা করলেন। অতঃপর স্পষ্ট কণ্ঠে ঘোষনা করলেন- আল্লাহই আমাদের একমাত্র রব্ব- সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক-রব্বুনাল্লাহু; মুসআবের মা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে ছেলের কথা শুনছিলেন। আর চিন্তা করছিলেন- যে সন্তানকে এতদিন তিনি এত আদর-যত্ন, বিত্ত-বৈভব দিয়ে বড় করেছেন, যে মুসআব তাঁর জীবনের সবকিছু, আজ সে এসব কী বলছে? মা সহ সমাজপতিদের সম্মুখে সত্য প্রকাশের এমন সুযোগ আর জীবনে নাও আসতে পারে তাই তিনি বলেই চললেন- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নেই কোন ইলাহ্-দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার অধিকারী সত্ত্বা একমাত্র আল্লাহ্ ব্যতীত এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল- আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। এরপর তিনি কুরআন থেকে কিছু আয়াত তিলাওয়াত করে শুনালেন, যে আয়াতগুলো কাফিরদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়েছিল এবং যে আয়াত শুনে চিরকালই মুমিনদের বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে।
যারা সেখানে এসেছিল, মুসআবের কথা শুনে তাদের কারো কারো হৃদয় শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং সত্যের প্রতি আবেগে আপ্লুত হলো, যদিও তা সংখ্যায় ছিল স্বল্প। কিন্তু মুসআবের এহেন কথা তার মা আর সহ্য করতে পারলেন না, পাগলপ্রায় হয়ে প্রচন্ড এক চপেটাঘাতে তার কণ্ঠকে জীবনের তরে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেন তিনি। কিন্তু সন্তানের প্রতি প্রবল ভালোবাসা তাঁকে তা করা থেকে বিরত রাখল, যদিও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করলেন- ছেলের এমন কাজের একটা উপযুক্ত শাস্তি তিনি দেবেন। আর তার এ প্রতিশ্রুতি মুসআবের জন্য ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে এলো। তিনি মুসআবকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলেন ঘরের এক কোণে এবং তাকে শক্ত করে বেঁধে ফেললেন আর দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেন। গৃহবন্দী হলেন মুসআব ইবনে উমাইর।
আল্লাহকে একমাত্র রব্ব মেনে নিয়ে ঈমান আনার কারণে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল মেনে তাঁর আনুগত্য করার কারণে মুসআব ইবনে উমাইর আজ গৃহবন্দী। মক্কার যে সমাজ তাদের প্রতিটি বৈঠকে মুআবের সরব উপস্থিতির আকাংখী ছিলো, যার উপস্থিতির কারণে তাদের অনুষ্ঠান প্রাণ ফিরে পেতো, যে ছিলো তাদের আদরের দুলাল সেই সমাজের লোকদের হাতেই আজ বন্দী মুসআব।
তাঁর মা ঘর পাহারা দেবার জন্য চতুর এবং শক্তিশালী কয়েকজন লোককে নিয়োগ করলেন। তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হলো যাতে মুসআব আর কোনভাবেই মুহাম্মাদের সাথে কোন যোগাযোগ না রাখতে পারে এবং নতুন বিশ্বাস সম্বন্ধে আর কোন কিছু জানতে না পারে। দীর্ঘদিন ধরে মুসআব এদের তীক্ষ্ণ পাহারায় বন্দী অবস্থায় থাকলেন। কিন্তু আল্লাহর প্রতি মুসআবের ঈমান এতটাই দৃঢ় ছিল যে, তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন আল্লাহ্ নিশ্চিতভাবেই তার অন্তরের অবস্থা জানেন। সুতরাং খুব বেশীদিন এ বন্দী জীবন-যাপন করতে হবে না। এরপরও রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং অন্যান্য মুসলিমদের খবর জানার জন্য তার হৃদয় উদগ্রীব হয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক তার এ খবর জোগাড় করতেই হবে। অবশেষে আল্লাহ’র ইচ্ছায় পাহারাদার বাহিনীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে তাঁর কাছে খবর পৌঁছালো যে, অমানুষিক অত্যাচার মুসলিমদের জর্জরিত করে ফেলছে এবং অত্যন্ত গোপনে একদল মুসলিম এ অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশে আবিসিনিয়ার (বর্তমানের ইথিওপিয়া) দিকে পাড়ি দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। মুসআব সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এ বন্দীদশা থেকে পালিয়ে মুসলিমদের সে দলটির সাথে আবিসিনিয়া চলে যাবেন। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলেন। মন তাঁর পড়ে আছে মুসলিম ইতিহাসে প্রথম হিজরতকারী দলটির কাছে। অবশেষে একদিন আল্লাহ্’র ইচ্ছায় সুযোগ এলো। দীর্ঘদিন বেঁধে রাখার পর একদিন তাঁর মা পাহারাদারদের বললেন কিছু সময়ের জন্য বাঁধন খুলে দিতে। কিছু সময় পর তাদের অমনোযোগিতার সুযোগে অত্যন্ত সন্তর্পণে তিনি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। আর দেরী করলেন না। দ্রুত তিনি মিলিত হলেন মুসলিম দটির সাথে। মিলিত হয়েই দেখা মিললো রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে। কতদিন! কতদিন পর আবার সে দ্বীনের রাহবার’এর সাথে দেখা হওয়া, যাকে তিনি নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবেসে ফেলেছেন। আনন্দে আর আবেগে তিনি শিশু বাচ্চার ন্যায় কাঁদছেন। হাতে সময় ছিল খুব কম। আল্লাহ্’র জন্য পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ত্যাগ করে হিজরতের জন্য প্রস্তুত একদল মুসলিমের সাথে তিনি চললেন লোহিত সাগরের দিকে। সেখানে অপেক্ষা করছিল নৌযান। দলটি আল্লাহ্’র নাম নিয়ে চড়ে বসল সেটিতে। নাবিক দ্রুত পাল তুললো। পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়া সে দলটির সঙ্গী হয়ে মুসআব ভেসে চললেন লোহিত সাগরের বুক চিরে আবিসিনিয়ার পথে।
উত্তাল সমূদ্রপথ পাড়ী দিয়ে দীর্ঘদিনের পথ পেরিয়ে এ দলটি একদিন পৌঁছে গেল আবিসিনিয়া। সেখানকার খৃস্টান বাদশাহ্ নাজ্জাশী ছিলেন খুব সহানুভূতিশীল মানুষ। তিনি মুসলিমদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন এবং নির্বিঘ্নে ইবাদাত করার সুযোগ দিলেন। নিজ জন্মভূমি ছেড়ে আসা দলটি আল্লাহ্’র জন্য অপরিচিত প্রবাসে শান্তিতেই দিন কাটাতে লাগলো। তবে এত কিছুর পরও তাদের অন্তরটা মক্কায় ফেরার জন্য হু হু করে উঠত। তাদের এ আকুলতার কারণ ধন-সম্পদ এবং ভিটেমাটির জন্য ছিল না, বরং তা ছিল প্রাণপ্রিয় রাসুল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য। রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশে তারা দেশ ত্যাগ করেছিলেন, তবে সবাই উদগ্রীব ছিলেন তাঁর কাছে ফিরে যাবার জন্য, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহচর্যের জন্য।
একদিন সে দলটির কাছে একটি খবর পৌঁছালো যে, মক্কার সকল মানুষ মুহাম্মাদের নতুন দাওয়াতকে গ্রহণ করেছে এবং দাওয়াত কবুলকারী বিশ্বাসীরা (ঈমানদাররা) সেখানে নির্বিঘ্নে আল্লাহ্’র ইবাদাত করতে পারছে। এ খবর শুনেই মুসআব রওযানা হলেন মক্কার পথে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মুসআব যখন মক্কায় পৌঁছলেন, গিয়ে শুনলেন পাওয়া খবর পুরোপুরি মিথ্যা, বরং কুরাইশ বাহিনীর আত্যাচার ও নির্যাতন আরো বেড়েছে। আবার তিনি ফিরে গেলেন আবিসিনিয়া। মুসলিম দলকে তিনি সতর্ক করে মক্কায় ফিরে আসা ঠেকালেন এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষাই শ্রেয় মনে করে আবিসিনিয়ায় আগের মতই দিন কাটাতে লাগলেন।
এদিকে মুসআবের মা খুনাইস ছেলের জন্য শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ছিলেন। তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন তাঁর ছেলেকে, যদিও ছেলের নতুন ধর্মবিশ্বাস ছিল তাঁর জন্য সহ্যের অতীত। ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়ছিলেন। তিনি জানতেন মুসআবও তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল মুসআব একদিন তার ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবেই।
আবিসিনিয়া থেকে মুসআব আবার একদিন মক্কায় ফিরে এলেন। মুসআব ফিরে এসেছেন মক্কায়। তিনি মক্কার পথে হেঁটে চলেছেন আর লোকজন কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে নতুন মুসআবকে দেখছে। এতে তিনি নিজেও কিছুটা পুলকিত হচ্ছেন এই ভেবে যে, লোকজন দেখুক যে মুসআব একসময় জাহিলয়্যাতের চরম ভোগ-বিলাসে জীবন কাটিয়েছে সে মুসআব এ নয়; এতো দ্বীন-ইসলামের এক নগণ্য খাদেম যার অনুসরণীয় একমাত্র আদর্শ হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর চাওয়া হচ্ছে বিশ্বজাহানের একমাত্র রব্ব মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি।
তার মা খুনাইসও খবর পেলেন ছেলে ফিরে এসেছে। দীর্ঘদিন পর মা আর ছেলের দেখা হলো। দু’জনেই আবেগাপ্লুত ছিলেন। খুনাইস আশা করেছিলেন ছেলে মুহাম্মাদের প্রচার করা অদ্ভুত বিশ্বাস ত্যাগ করে ফিরে এসেছে, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি বুঝলেন তাঁর এই ধারণা ভুল। ক্রোধে তিনি ফেটে পড়লেন। মুসআবকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য তিনি শেষ চেষ্টা করবেন বলে স্থির করলেন এবং এটা কোন সহজ কায়দায় ছিল না, তিনি ছেলেকে আবার বন্দী করে বেঁধে ফেলার জন্য ভৃত্যদের ডেকে আদেশ করলেন। মুসআব মায়ের সকল অত্যাচার কোন প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিয়েছিলেন সবসময়। কিন্তু এবার তিনি মাকে শপথ করে বললেন, কেউ যদি তাকে বন্দী করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের সবাইকে তিনি হত্যা করবেন। খুনাইস জানতেন তাঁর ছেলে কখনও অনর্থক কথা বলে না। তার উপর তার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাও তাঁকে অবাক করেছিল।
মা আর সন্তানের বিচ্ছেদ ধীরে ধীরে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল যদিও দু’জন দু’জনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। মা-পুত্র দু’জনই এহেন পরিণতি মেনে নিতে পারছিলেন না, কিন্তু এর মাধ্যমে ঈমানের উপর মুসআবের এবং কুফরের উপর খুনাইসের অটল দৃঢ়তা স্পষ্ট হয়ে উঠল। খুনাইস মুসআবের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মুসআব পরিবারের বিশাল ঐশ্বর্য আর বিত্তের উত্তরাধিকারী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। দু’জনের শেষ কথোপকথনে খুনাইস বললেন, “যে পথে তুমি পা বাড়িয়েছ, তুমি সে পথেই চলে যাও। তবে জেনে রাখো, আজ থেকে আমি আর তোমার মা নই।”
ইসলামের ইতিহাসে আরেক সংকটময় ঈমানী পরীক্ষার মুখোমুখী মা ও ছেলে : কুফরের উপর অটল মা আর ঈমানের উপর অটল ছেলে। কী করা উচিত মুসআবের? একদিকে মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা-অভিমান অপরদিকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য। মুসআব রাযিআল্লাহু আনহু পড়লেন উভয় সংকটে। তিনি কি তার মায়ের ভালোবাসা, অভিমানকে গুরুত্ব দিবেন, না আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে সর্বোচ্চে স্থান দিবেন। আমাদের সমাজে আমরা অনেক মুসলিম নামধারী পরিবার দেখতে পাই যারা দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে অতটা সচেতন নন, শ্রদ্ধাশীল নন। মূলত তারা ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হননি; জন্মসূত্রে মুসলিম দাবীদার তাই দ্বীন সম্পর্কে মৌলিক কোন ধারণাই রাখেন না। আর এরকম বাবা-মা তাদের সন্তানকে সত্য দ্বীন-ইসলামের দাওয়াতের রাস্তা থেকে সরাতে গিয়ে এই বলে বিভ্রান্ত করে যে, আল্লাহ্ কি সন্তানকে মা-বাবার আনুগত্য ও সন্তুষ্টি বিধানের নির্দেশ দেননি? আল্লাহতো বাবা-মায়ের কথা মানতে বলেছেন; সুতরাং তুমি কেন এগুলোকে বাদ দিয়ে শুধু ইসলামের দাওয়াতকেই বেশী গুরুত্ব দিচ্ছ?
কথা সত্য, কারণ আল্লাহ্ সূরা বণী ইসরাঈলে (২৩নং আয়াতে) বলেছেন, “তোমার রব্ব আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে উহ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।”
অথচ এসব বাবা-মা হয়তো জানেনই না যে, সূরা আনকাবুতে (৮নং আয়াতে) আল্লাহ্ এও বলেছেন, “আমি মানুষকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করতে।”
স্বীয় নফসের সাথে অনেক বোঝাপড়ার পর মুসআব আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দিকে অন্তরকে রুজু করে উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে এগিয়ে মা’র খুব কাছে গিয়ে বসলেন।
“মা, আপনাকে আমি জানি আর আমি ভালোবাসি আপনাকে। আমি আপনাকে ‘আশহাদু আল্-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু-নেই কোন ইলাহ্-দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা পাওয়ার সত্ত্বা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া এবং মুহাম্মাদ আল্লাহ্’র বান্দাহ্ ও রাসূল’-এ সাক্ষ্য দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”
“আকাশের ছুটন্ত তারকার শপথ, আমার অন্তর, চিন্তাশক্তি যদি লোপও পেয়ে যায় তবুও আমি তোমার এ দ্বীন গ্রহণ করবো না।”
মুসআব ঘর ছাড়লেন। পেছনে ফেলে এলেন বিপুল ঐশ্বর্য আর বিলাসিতার জীবন। আরব্য অঞ্চলের যে-ই তাঁর এ অবস্থার কথা শুনত, ভীষণ অবাক হয়ে ভাবত এও কিভাবে সম্ভব!
দ্বীনের কারণে মুসআব আজ গৃহহারা, মা থেকেও নেই। একবেলা খান তো আরেক বেলা উপোস থাকেন। দ্বীনের মুহব্বতে পেটের ক্ষুধা অন্তরে চলে এসেছে কিন্তু অন্তরতো সর্বক্ষণই রব্বের সন্তুষ্টিতে পরিপূর্ণ, তাই ক্ষুধা ও দরিদ্রতার কষ্ট তাকে গ্রাস করতে পারেনি। বাড়ী-ঘর ছাড়া মুসআব ঘুরে বেড়ান মদীনার পথে পথে। অনাহারে অর্ধাহারে অপুষ্টিতে তার গায়ের চামড়া এমনভাবে উঠে গিয়েছিল যেমন সাপ তার খোলস পরিবর্তন করে।
মুসআব এবার সমস্ত পিছুটান, বন্ধন মুক্ত। তিনি এবার সমস্ত চিন্তা, চেতনা ও মেধা ইসলামের জন্য নিবেদন করলেন। অসম্ভব মেধাবী এ ছেলেটি ইসলামের জ্ঞানে ধীরে ধীরে নিজেকে পরিপূর্ণ বিকশিত করতে লাগলেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসআবকে অত্যন্ত ভলোবাসতেন।
এর কয়েক বছর পরের কথা। একদিন মুসআব রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে এলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে ঘিরে মুসলিমদের একটি দল বসে ছিল। দূর থেকে মুসআবকে আসতে দেখে উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। দলের অনেকেই কেঁদে ফেললেন। কারণ মুসআবের পরণে ছিল একটি তালি দেয়া জীর্ণ জুব্বা।
ইসলাম পূর্ব মুসআবের ছবি তাদের হৃদয় পটে ভেসে উঠলো। এই কি সেই মুসআব! একদিন যার গায়ে থাকত আরবের সবচেয়ে দামী পোষাক, আরবের বিলাসিতা আর সৌন্দর্যের মডেল ছিল সে। সে ছিল বাগানের উৎকৃষ্ট কোমল, চিত্তাকর্ষক ও সুগন্ধীময় ফুলের ন্যায়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসআবের দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল হলেন। তার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এ মুসআবকে আমি মক্কায় তার বাবা-মার সাথে দেখেছি। তাঁরা ওকে খুব যত্ন করতেন এবং তার সাচ্ছন্দের জন্য সবকিছুই করেছেন। কুরাইশদের মধ্যে কোন যুবকই তার মত ছিল না। এরপর এ সমস্ত কিছু সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ত্যাগ করে এসেছে এবং নিজেকে সে রাসূলের কাজে নিবেদিত করেছে।”
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে চললেন,
“একদিন সে সময় আসছে যখন আল্লাহ্ তোমাদের পারস্য এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উপর বিজয় দান করবেন। তোমাদের গায়ে তখন সকালে থাকবে একটি পোষাক আর বিকেলে আরেকটি। তোমরা সকালে খাবে একরকম খাবার আর বিকেলে খাবে আরেকরকম।”
রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রকারান্তরে অচিরেই মুসলিমদের ক্ষমতা আর সম্পদের প্রাচুর্যের আভাস দিলেন। তখনকার যুগে আরবদের যে অবস্থা ছিল, সে অবস্থা বিবেচনায় রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এ কথা ছিল অলীক কল্পনার মত। কিন্তু আল্লাহ্’র রাসূল তো মিথ্যা বলতে পারেন না। সঙ্গী সাহাবীরা তাই ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- “ইয়া রাসূলুল্লাহ্, আমাদের জন্য কোন সময়টা মঙ্গলজনক হবে, এখনকার সময়টা নাকি তখনকার?” রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তোমাদের জন্য বরং এখনকার সময়টিই মঙ্গলজনক। যে বিশ্বের কথা আমি জানি, সে বিশ্বের কথা যদি তোমরা জানতে তাহলে অবশ্যই তোমরা সে বিশ্বের সাথে নিজেদেরকে জড়ানো পছন্দ করতে না।”
ইসলাম আবির্ভবের প্রায় দশটি বছর কেটে গেল। কিন্তু মক্কার মানুষরা ইসলাম এবং রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর আগের মতই অত্যাচার এবং আক্রমন চালিয়ে যেতে লাগল। অত্যন্ত ধৈর্য্যশীল রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নতুন ঠিকানা খোঁজার জন্য মক্কার অদূরে তায়েফে গেলেন সত্যের বার্তা নিয়ে। কিন্তু সেখানকার মানুষ তাঁকে ভীষন অত্যাচারে জর্জরিত করে ফেলল। এমনকি তায়েফ শহর থেকে তাঁকে বের করে দেয়া হলো। ইসলামের আকাশ যেন কালো মেঘে ছেয়ে গেল। কোথাও কোন আশ্রয় এবং বন্ধু নেই। গুটিকয়েক অবিচল সাহাবী রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে আল্লাহ্’র দীন আঁকড়ে ধরে ছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা এ প্রজন্মটির পরেই স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ্’র ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। মুসলিমদের এই চরম দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় তৎকালীন ইয়াসরিব আর আজকের মদীনা থেকে বেশ কয়েকজনের একটি দল রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করল এবং আল্লাহ্’র রাসুলকে তাদের ভূমিতে এসে বসবাসের আনুরোধ জানালো। তাঁরা রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে তাঁকে এবং অন্য মুসলিমদের পূর্ণ নিরপত্তা দেবার জন্য ওয়াদা করলেন।
রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ’র পক্ষ থেকে আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। মদিনা থেকে আগত নতুন মুসলিমরা তাঁর কাছে অনুরোধ করলো সেখানে একজন দা’য়ী (যিনি মানুষকে আল্লাহ্’র দিকে ডাকবেন) এবং ইসলামিক কালচার এবং আল্লাহ্’র বিধান শিক্ষা দেবার জন্য একজন শিক্ষক পাঠাতে। এ ছিল এক কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ কাজের জন্য দরকার হলো একজন নির্ভীক এবং জ্ঞানী মুসলিমের। এ কাজটি করার জন্য তখনকার প্রতিটি মুসলিম উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত উন্নত ও দৃঢ় চরিত্র, উত্তম ব্যবহার কুরআনের উপর অগাধ জ্ঞান এবং প্রখর বুদ্ধিমত্তার জন্য রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কাজের জন্য নির্বাচিত করলেন মুসআব ইবন্ উমাইরকে। রাসূলের নির্দেশ পেয়ে আল্লাহ্’র নাম নিয়ে মুসআব বেরিয়ে পড়লেন মক্কা ছেড়ে মদিনার পথে। বিশাল মরুভূমির বুক চিরে, শত্রুদের ভয়কে তুচ্ছ করে মুসআব একাকী এগিয়ে চললেন রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিয়োগকৃত ইসলামের প্রথম দা’ঈ হয়ে।
এই মিশন সম্বন্ধে মুসআব খুব ভালোভাবে জানতেন। তিনি জানতেন এ মিশনের মাধ্যমে একইসাথে তাঁকে মানুষকে আল্লাহ্ এবং ইসলামের সরল পথের দিকে ডাকতে হবে এবং নির্যাতিত মুসলিমদের ভবিষ্যতের জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে।
মদীনায় মুসআব প্রবেশ করলেন সেখানকার বিখ্যাত খাজরাজ গোত্রের সা’দ ইবনে জুরারাহ্-এর মেহমান হিসাবে। তাঁরা দুজন মিলে এরপর শুরু করলেন মানুষকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর কাজ। তারা মানুষের ঘরে ঘরে এবং যে কোন মজলিশে গিয়ে রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা বলতে লাগলেন, ইসলামের কথা ব্যাখ্যা করে বুঝাতেন এবং কুরআন থেকে আল্লাহর কথা তাদেরকে শুনাতেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে মদীনার আনেকেই তখন ইসলাম গ্রহণ করলেন। এ ছিল মুসআবের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক কিন্তু মদীনার তৎকালীন অনেক নেতাদের জন্য এক অশনী সংকেত।
একবার মুসআব এবং সা’দ বনু জাফর এর একটি বাগানে বসে ছিলেন। তাঁদের সাথে ছিলেন আরো কয়েকজন মুসলিম এবং ইসলামের প্রতি উৎসাহী লোকজন। মদীনার তখনকার বিখ্যাত ও প্রভাবশালী নেতা উসাইদ ইবনে হুদাইর এ খবর পেলেন যে মক্কা থেকে আগত সে যুবক কিছু স্বধর্মত্যাগী লোকজনসহ সেখানে অবস্থান করছে। ভীষণ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি ছুটে আসতে থাকলেন সে দলটির দিকে। সা’দ ইবনে জুরারাহ্ তাঁকে দেখতে পেলেন এবং মুসআবকে সতর্ক করে বললেন- “উসাইদ ইবনে হুদাইর আমাদের দিকে ছুটে আসছে। সে হল তার গোত্র এবং এ শহরের অনেক বড় নেতা। আল্লাহ্ তাঁর অন্তরকে সত্য গ্রহন করার জন্য প্রস্তুত করে দিন।”
একজন আদর্শ দা’ঈর মত শান্তভাবে মুসআব বললেন, “তিনি যদি এসে আমাদের কাছে বসেন তাহলে আমি তাঁর সাথে কথা বলব।”
রাগে উত্তেজিত উসাইদ ধারালো বর্শা হাতে দলটির কাছে এসে চীৎকার করে মুসআব এবং তাঁর আশ্রয়দাতা সা’দকে হুমকি দিয়ে বললেন, “তোমরা দু’জন কেন এখানে এসেছো এবং আমাদের দুর্বল লোকদের বিভ্রান্ত করে ফেলছো? যদি তোমরা বেঁচে থাকতে চাও তাহলে এখনি এখান থেকে চলে যাও।” মুসআব উঠে স্মিত হেসে শান্তভাবে উসাইদকে বললেন, “আপনি দয়া করে একটু বসে আমাদের কথা শুনুন। যদি আমাদের বক্তব্য আপনার কাছে ভালোলাগে এবং গ্রহনযোগ্য মনে হয় তাহলে আপনি তা গ্রহণ করবেন, আর যদি তা আপনার কাছে অপছন্দনীয় হয় তাহলে আমরা আপনাকে আর বলব না, বরং আপনার এলাকা ছেড়ে চলে যাব।”
“তা করা যেতে পারে।” উসাইদ বললেন এবং বর্শাটা মাটিতে গেঁথে বসে পড়লেন।
মুসআব শান্তভাবে উসাইদকে ঈমান ও ইসলাম সমপর্কে বললেন এবং কুরআন শোনাতে লাগলেন। উসাইদ ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর চেহারা সত্যের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছিল। অন্তরে তোলপাড় করে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল মুসআবের মুখে শোনা কুরআনের বাণীগুলো। তিনি বললেন, “কী অসাধারণ আপনার কথাগুলো আর কী সত্য। কেউ যদি এ দীন গ্রহণ করতে চায় তাহলে তাকে কি করতে হয়?”
মুসআব বললেন-
“আপনি গোসল করে পরিস্কার কাপড় পরে আসুন। এরপর সত্যের ঘোষণা ও সাক্ষ্য দিন এবং সালাত আদায় করুন।”
উসাইদ উঠে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে এলেন। তিনি সত্যের ঘোষনা দিলেন- আল্লাহ্-ই আমার একমাত্র রব্ব-সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান এবং কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক এবং সাক্ষ্য দিলেন যে- আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। এরপর তিনি দু’ রাকাত সালাত আদায় করলেন। তারপর বললেন,
“আমার পর এখানে এমন একজন মানুষ আছেন, যিনি এ গোত্রের বড় নেতা এবং তিনি যদি আপনার কথা মেনে ইসলামে প্রবেশ করেন তাহলে এ গোত্রের সকলেই ইসলামে প্রবেশ করবে। তিনি সা’দ ইবনে মুয়াজ। আমি এখন তাঁকেই আপনার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
উসাইদ এরপর সা’দ ইবনে মুয়াজকে কৌশলে মুসআবের কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং তিনিও মুসআবের কথা শুনে আল্লাহ্’র ইচ্ছায় ইসলামে প্রবেশ করলেন। মদীনা তখন ছিল দু’টি বিখ্যাত গোত্র এবং এ দু’টি গোত্রের নেতৃত্বে ছিল দুজন সা’দ। আউস গোত্রের নেতৃত্বে ছিল এই সা’দ ইবনে মুয়াজ এবং খাজরাজ গোত্রের নেতৃত্বে ছিল সা’দ ইবনে উবাদা। মুসআবের দাওয়াতে সা’দ ইবনে মুয়াজ ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এরপর একদিন অন্য সা’দ অর্থাৎ সা’দ ইবনে উবাদাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। মদীনার লোকরা তখন অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলো চির বৈরী আউস আর খাজরাজ গোত্রের দুই প্রধান নেতা মক্কা থেকে আগত এক সাধারণ কিন্তু সুদর্শন যুবকের হাত ধরে সকল বৈরীতার অবসান ঘটিয়ে ফেলেছে, যেটা সুদীর্ঘ শতাব্দী ধরেই অসম্ভব বলেই সবাই মনে করত। লোকজন বলল-
“যদি সা’দ ইবনে মুয়াজ, সা’দ ইবনে উবাদা আর উসাইদ ইবনে হুদাইর এর মত লোক নতুন এ দ্বীনটি গ্রহণ করে থাকে, তবে আমরা কেন নয়? এসো সবাই সত্যবাদী মুসআবের কাছে যাই আর ইসলামে প্রবেশ করি।”
আর এভাবেই মুসআব, রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ইসলামের প্রথম দূত আল্লাহ্’র পথে মানুষকে দাওয়াতে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করলেন। সত্যিই আল্লাহ্’র রাসুলের দূত নির্বাচন ছিল অনন্য সাধারণ, যার হাতে পুরুষ ও নারী, যুবা ও বৃদ্ধ, ক্ষমতাবান ও ক্ষমতাহীন নির্বিশেষে সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এভাবেই এ যুবকটি আজকের মদীনা এবং তৎকালীন ইয়াসরিবের সুদীর্ঘ বৈরীতার ইতিহাসের গতিপথ চিরতরে বদলে দিয়েছিল। আল্লাহ্ কর্তৃক ঘোষিত মর্যাদাপূর্ণ আনসার হবার জন্য ইয়াসরিববাসী তৈরী হয়েছিল এবং বিশ্ব ইতিহাসে মুসলিমদের প্রথম কেন্দ্র হবার মর্যাদা লাভের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ইয়াসরিব।
মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা যখন একটু বেড়ে গেলো, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট অনুমতি চাইলেন হযরত সা’দ ইবন খুসাইমার (রাযিআল্লাহু আনহু) বাড়ীতে জুমুআর সালাত শুরু করার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি দিলে তিনিই প্রথম সা’দ ইবন খুসাইমার (রাযিআল্লাহু আনহু) বাড়ীতে তাঁরই ইমামতিতে জুমুআর সালাতের সূচনা করেন। সালাতের পর একটি ছাগল যবেহ করে মুসল্লিদের আপ্যায়ন করা হয়। (তাবাকাত)
ইয়াসরিবে মুসআবের আগমনের এক বছরের কিছু কম সময়ের মধ্যেই হজ্ব মৌসুমে মুসআব আবার মক্কা ফিরে এলেন। এবার তাঁর সাথে এল মদীনার পঁচাত্তর জন মুসলিমের এক বিশাল দল। মুসআবের কথায় এরা রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে না দেখেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাই দলটির সবাই প্রিয় রাসূলকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। মক্কার কাছে সেই বিখ্যাত আকাবা উপত্যকাতেই রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে তাদের দেখা হল। তাঁকে দেখে সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিল এবং তাঁদের রব্বের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিল। দলটির সবাই রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করল এবং প্রতিজ্ঞা করল যে ইসলাম এবং রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিরাপত্তার জন্য সব কিছুই তারা করবে। আল্লাহ্’র রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন যে, যদি তারা তাদের বিশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকে তাহলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জান্নাত। ইসলামের ইতিহাসে এ ঘটনাটি আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াত নামে পরিচিত, যার অসম্ভব মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে।
এ ঘটনার অল্প কিছুদিন পরই রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কার মুসলিমদের ইয়াসরিবে হিজরতের নির্দেশ দিলেন। যে প্রতিশ্রুতি আকাবায় মদীনার মুসলিমরা দিয়েছিল, তা তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল এবং আনসার বা সাহায্যকারী হিসাবে হিজরতকারী মুহাজিরদের ভাতৃত্ব ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। হিজরতকারী মুহাজিরদের মধ্যে প্রথম ছিল মুসআব এবং আবদুল্লাহ্ ইবনে উম্মে মাখতুম নামের প্রসিদ্ধ অন্ধ সাহাবী, যিনি ছিলেন আকর্ষনীয় কন্ঠস্বরের অধীকারী। তিনি এবং মুসআব ইয়াসরিবের মানুষকে কুরআন থেকে পড়ে শুনাতেন এবং শিক্ষা দিতেন।
হিজরত পরবর্তী মদীনার সমাজ গঠনেও মুসআব ছিলেন অত্যন্ত কর্মতৎপর। হিজরতের কিছুদিন পরেই অনুষ্ঠিত হয় ইসলাম এবং কুফর এর মধ্যে প্রথম যুদ্ধ, যা বদরের যুদ্ধ বলে খ্যাত। বদরের যুদ্ধে মুসআব অসামান্য বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন। তবে বদরের যুদ্ধ পরবর্তী মুসআবের একটি ঘটনা ইতিহাস প্রসিদ্ধ।
যুদ্ধ শেষ হবার পর মুসলিমদের হাতে কুরাইশ বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধবন্দী হিসাবে আটক হয়। সব বন্দীকে রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি তাদেরকে আলাদা আলাদাভাবে মুসলিম হেফাজতে দিয়ে দেন এবং বলে দেন- “তাদের সাথে ভাল আচরণ করো।”
বন্দীদের মধ্যে একজন বন্দীর নাম ছিল আবু আজিজ ইবনে উমাইর। এ আবু আজিজ ছিল মুসআব ইবনে উমাইর এর ভাই। যুদ্ধবন্দী থাকাকালীন সময়কার কথা আবু আজিজ পরে বর্ণনা করেন- “বন্দী থাকা অবস্থায় আমি একদল আনসারের দায়িত্বে ছিলাম। তারা যখনই খেতে বসছিল তখনই আমাকেও রুটি এবং খেজুর খেতে দিচ্ছিল, এ ছিল রাসূলের নির্দেশ পালন, যে নির্দেশে তিনি তাদেরকে আমাদের সাথে ভাল আচরণ করতে বলেছিলেন। আমার ভাই মুসআব একসময় আমার পাশ দিয়ে গেলেন এবং আনসারদের যে ব্যক্তিটি আমার বন্দীত্বের দায়িত্বে ছিল তাকে বললেন, “একে শক্ত করে বাঁধ, এর মা হলেন একজন অত্যন্ত সম্পদশালী মহিলা এবং তিনি এর বিনিময়ে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে সক্ষম।”
আবু আজিজ যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে মুসআবের দিকে ফিরে তিনি বললেন, “আপনি আমার ভাই, আমার ব্যাপারে এই কি আপনার নির্দেশনা?!”
“তিনি হলেন আমার ভাই, তুমি নও”, সাথের আনসার সাহাবীকে দেখিয়ে বললেন মুসআব।
এভাবেই মুসআব ঈমান এবং কুফর এর পার্থক্যকে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন এবং কুরআনের ঘোষনা অনুযায়ী মু’মিনকে ভাই হিসাবে নিয়ে নিজের মুশরিক ভাইকে বর্জন করার অনন্য উদাহরণ রেখেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন ঈমানের বাঁধন পৃথিবীর আর সব বাঁধনের চেয়ে দৃঢ়!
এ প্রসঙ্গে কুরআনে সুস্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে- “ওহে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের স্বীয় পিতা ও ভাইদেরকেও বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যদি তারা ঈমানদারীর পরিবর্তে কুফরীকে ভালবাসে। তোমাদের কেউ যদি তাদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তবে তারাই হবে আত্মঘাতী যালিম।” (সূরা আত্ তাওবা ৯:২৩)
উহুদ যুদ্ধের সময় রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুসআবকে ডেকে পাঠালেন। ইতিমধ্যে সাহাবীগন তাঁকে মুসআব আল খাইর (সৎলোক মুসআব) উপাধীতে ভূষিত করেছেন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পতাকা রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তুলে দিলেন মুসআবের হাতে। এ ছিল সমগ্র সাহাবী সমাজে অত্যন্ত বিরল সম্মান এবং গর্বের বিষয়। সঠিক মানুষকে সঠিক দায়িত্ব ও কাজের জন্য নির্বচিত করার যে বিস্ময়কর ক্ষমতা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে দিয়েছিলেন, যার আরেকটি প্রয়োগ তিনি করলেন মুসআবের হাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা তুলে দিয়ে।
যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের অবস্থা দর্শনে মনে হল মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করতে চলেছে। তখনই একদল মুসলিম রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে গণিমতের মাল লাভ করার জন্য স্থান ত্যাগ করল। মুশরিক বাহিনীর একটি দল এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাল্টা আক্রমন করে বসল, ফলশ্রুতিতে ভীষণ আক্রমণের মুখে মুসলিম বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। মুশরিক বাহিনীর সদস্যরা একটি লক্ষ্যের উপরই দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল আর তা হল রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে খুঁজে বের করা এবং হত্যা করা। দূরদর্শী মুসআব তাদের এ ভয়ংকর দূরভিসন্ধির ব্যপারটি ধরে ফেললেন। রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমূহ বিপদে তিনি কি করবেন তা তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিলেন। মুহূর্তেই তিনি তাঁর হাতে ধরা মুসলিম বাহিনীর পতাকাটি উঁচুতে তুলে ধরলেন এবং উচ্চস্বরে তাকবীর দিতে লাগলেন। তাঁর চীৎকারে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহীর দিকে মুশরিকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এবং তারা প্রথমে এ পতাকাকে ভূলন্ঠিত করে পরবর্তি লক্ষ্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিল। একজন মুশরিক সেনারা তার ওপর আক্রমণ করলো। একহাতে মুসলিম বাহিনীর পতাকা আর অন্যহাতে তরবারী নিয়ে তিনি প্রচন্ড বেগে লড়াই করতে থাকেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে এক অশ্বারোহী মুশরিক সেনা তরবারীর আঘাতে মুসআবের ডান হাত তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তিনি তৎক্ষনাত বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়ল যে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিহত হয়েছেন। একথা শুনে মুসআব বলে উঠলেন, ‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল…আর মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল! তাঁর পূর্বেও বহু রাসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।”
অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো একজন রাসূল, একজন মানুষ, তার মতো বহু রাসূল ইতিপূর্বে গত হয়ে গিয়েছে। সুতরাং আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ গত গেছেন বলেকি আমরা ইসলামকে ছেড়ে দিব? আমরাকি আবার জাহিলিয়্যাতের মধ্যে ফিরে যাব?
তিনি জানতেন ব্যক্তি মুহাম্মাদের মৃত্যু হতে পারে কিন্তু তাঁর প্রচারকৃত দ্বীনতো আল্লাহ্’র দ্বীন, যা কখনও ধ্বংস হবার নয়। তিনি যখন চীৎকার করে একথা বলছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যু হয়েছে শুনে যে সকল মুসলিম একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, তারা সবাই যেন জেগে উঠলেন। ইতিমধ্যে আরেক মুশরিক সেনা তাঁর বাঁ হাতটি বাহু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। তিনি এবার বাহু দুটির অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা আঁকড়ে ধরে রাখলেন এবং চীৎকার করে বলতে লাগলেন- “মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে” তবুও ইসলামের পতাকাকে ভুলুন্ঠিত হতে দিলেন না । এমতাবস্থায় ইবনে কামিয়া নামের এক নরাধম এসে একটি তীক্ষ্ম বর্শা দ্বারা তাঁর দেহে আঘাত করলো, বর্শাটি তাঁর দেহটাকে এফোঁর ওফোঁর করে ফেলল। এবার মুসলিম বাহিনীর পতাকা মাটিতে পড়ে গেল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি যে কথাটি (‘ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রাসূল…মুহাম্মাদ কেবলমাত্র আল্লাহ্’র একজন রাসূল, তাঁর পূর্বেও রাসূলদের মৃত্যু হয়েছে) বলে গেছেন, পরবর্তিতে সে কথা রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আল্লাহ্ কুরআনের একটি আয়াত (সূরা আলে ইমরান:১৪৪) হিসাবে অবতীর্ণ করেছেন এবং পৃথিবী ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এ কথাটি আল্লাহ্’র পক্ষ থেকে সংরক্ষিত থাকবে।
যুদ্ধ শেষ হল। রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যুদ্ধের ময়দান ঘুরে ঘুরে শহীদ মুসলিমদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এবং তাদের জানাজার আয়োজন করছিলেন। এক সময় ঘুরতে ঘুরতে তিনি প্রিয় মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পেলেন। রক্ত আর ধুলোবালিতে একাকার তার চেহারা। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অঝোরে কেঁদে ফেললেন। মুসআবের দেহকে ঢেকে দেবার জন্য একখন্ড কাপড় চাওয়া হলেও তাঁর পরিধেয় একপ্রস্থ চাদরটি ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। যে চাদরটি তাঁর গায়ে ছিল সেটি দিয়ে তাঁর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ছিল এবং মাথা ঢাকলে পা বেরিয়ে পড়ছিল। অবশেষে রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন- “চাদরটি দিয়ে ওর মাথা ঢেকে দাও এবং পা ইখজির (এক প্রকার ঘাস) দিয়ে ঢেকে দাও।”
উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রিয় অনেক মানুষকে হারিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন তাঁর চাচা হামযা, যার দেহকে কাফিররা পৈশাচিকভাবে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিল। কিন্তু মুসআবের দেহের সামনে এসে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন সেই সময়কার কথা, যখন তিনি মুসআবকে প্রথম দেখেছিলেন মক্কায়। তখন সে ছিল মক্কার সবচেয়ে স্টাইলিশ যুবক, তার গায়ে ছিল সময়ের সেরা এবং দামী পোষাক, অথচ আজ তার মৃতদেহটিকে ঢেকে দেবার জন্য একটি পূর্ণ কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কুরআনের এক অনন্যসাধারণ (সূরা আহযাবের ২৩নং) আয়াত পড়লেন মুসআবের জন্য-“মিনাল মু’মিনীনা রিজালুন সাদাকু আহাদুল্লাহ আলাইহি… মুমিনদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে।”
তারপর তার কাফনের চাদরটির প্রতি তাকিয়ে বলেনঃ “আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারো ছিলো না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধূলিমলিন অবস্থায় পড়ে আছ।’’
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরপর অশ্রুশিক্ত নয়নে যুদ্ধক্ষেত্রের চারদিকে মুসআব এবং তার অন্য শহীদ সাথীদের লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহ্’র রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তোমরা হলে শহীদ এবং কিয়ামাতের দিন এ মর্যদা নিয়েই তোমরা উত্থিত হবে।”
সত্যিই, রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এ স্বীকৃতি একজন মু’মিনের জন্য পৃথিবীর সেরা প্রাপ্তি, যা মুসআব অর্জন করে আল্লাহর কাছে পৌঁছেছিলেন।
রাসুলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরপর তাঁর সঙ্গী অন্য সাহাবীদের দিকে ফিরে বললেন-
“ওহে জনমন্ডলী, তোমরা তাঁদের এখানে (উহুদ প্রান্তরে) এসো, তাদের কাছে এসো, তাদের ওপর সালাম পেশ কর। যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই মহান সত্ত্বার শপথ, কিয়ামাতের আগ পর্যন্ত যে সকল মুসলিম তাদের কাছে সালাম পৌঁছাবে, তাঁরা তাদের সেই সালামের জবাব দেবে।”
হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত বলেন, “আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হিজরত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যারা তাঁদের এ কাজের প্রতিদান মোটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে, তাঁদের একজন মুসয়াব ইবনে উমাইর।”
হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রাযিআল্লাহু আনহুর স্ত্রী হামনা বিনতে জাহাশ (রাযিআল্লাহু আনহা)। যুদ্ধের পর কেউ একজন তাকে সংবাদ পৌঁছে দিল, তোমার ভাই আবদুল্লাহ্ বিন জাহাশ ওহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন, এ সংবাদ শুনে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং সবর করলেন। এরপর কেউ একজন সংবাদ দিল, তোমার মামা হামযা বিন আব্দুল মুত্তালিব শাহাদাত বরণ করেছেন; তিনি আবারও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং সবর করলেন। অবশেষে তাকে জানানো হলো তোমার প্রিয়তম স্বামী মুসআব শাহাদাত বরণ করেছেন। এবার আর তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বাঁধভাঙ্গা অশ্রু সমেত সশব্দে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
আল্লাহ্’র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর অগণিত নাম না জানা ঈমানদার মুসলিম যারাই উহুদ প্রান্তরে গিয়েছেন, তাঁদের উপর সালাম পেশ করেছেন, নিশ্চিতভাবে তাঁরা (শহীদগণ) এর জবাব দিয়েছেন। আসুন আজ আমরা, যে যেখানে বসে আছি, তাদের কাছে সালাম পৌঁছে দিই-
আস্সালামু আলাইকুম ইয়া মুসআব…
আস্সালামু আলাইকুম মা’শার আশ্-শুহাদা…
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্ ওয়া বারাকাতুহু।
আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক মুসআব……..
সকল শহীদদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক……..
আপনাদের উপর বর্ষিত হোক আল্লাহ্’র শান্তি, দয়া ও রহমত।
আমি নিশ্চিত, আপনিও নিশ্চিত থাকুন, যদি আপনি মু’মিন হয়ে থাকেন, তাঁরা আপনার এ কথার জবাবে আপনার উপরও সালাম পাঠিয়েছেন।
মুসআব আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলেন, সবকিছুর উপরে দ্বীন। এ দ্বীনের জন্য তিনি জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেলেন। হযরত মুসয়াব (রাযিআল্লাহু আনহু) ছিলেন প্রখর মেধাবী, উদার ও প্রাঞ্জলভাষী বাগ্মী। যে দ্রুততার সাথে ইয়াসরিবে (মদীনা) ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল তাতেই তার এসব গুণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তার শাহাদাত পর্যন্ত যতটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিলো, তিনি মুখস্ত করেছিলেন। তাই-
যিনি নিজেকে আদর্শ মুসলিম হিসাবে গড়তে চান,
যিনি নিজে একজন দায়ী,
যিনি দাওয়াতী কাজের প্রেরণালাভের জন্য একজন স্মার্ট এবং সদাপ্রফুল্ল আদর্শ ব্যক্তির চিত্র খোঁজেন,
যিনি আল্লাহর জমীনে আল্লার দ্বীন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন,
তাঁর জন্য মুসআব বিন উমায়ের জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে । কারণ, মুসআব ছিলেন উসওয়ায়ে হাসানা মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুকরণে গড়ে উঠা মানুষ । চেহারায়, ব্যক্তিত্বে, বিচক্ষণতায়, শৌর্যে, বীর্যে, ধৈর্যে, ঔদার্যে, বীরত্বে, স্মার্টনেসে, বুদ্ধির দীপ্ততায়, সৌরভে, ত্যাগে, কুরবাণীতে, তিনি নিজকে আল্লাহর রাসুলেরই অনুকরণে গড়ে তুলে ছিলেন । এই ‘মিল’ এতটাই ছিল যে হত্যাকারী নিজেই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভেবে মুসআবকে হত্যা করেছিল ।
যারা ভীরু, কাপুরুষ, কথায় এবং কাজে যাদের মিল নেই, জালিমের সামনে সত্য উচ্চারণে যারা দ্বিধান্বিত, যারা যাদের বিশ্বাস অথবা কর্ম মুনাফেকীর চিহ্ণ বহন করে, তাদের জন্য মুসআব বিন উমায়েরের জীবনে কোন আদর্শ নেই।
প্রবন্ধটির জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আসহাবে রাসূলের জীবন কথা –প্রথম খন্ড।
Facebooktwitterredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

*