উম্মাহর বিশ্বস্ত ব্যক্তি
.
‘আমানত’ একটি পারিভাষিক শব্দ। যার অধীনে সকল প্রশংসনীয় গুণাবলী এসে যায়। এ জন্যই তাে যৌবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপাধি হয় ‘আল-আমীন’। যা ‘আমানাহ’ শব্দমূল থেকে উদ্গত। সুতরাং বুঝা যায়, শব্দটি ব্যাপক অর্থবােধক।
.
সততা ও সত্যবাদিতা, স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা, দৃঢ়তা ও অবিচলতা এবং বদান্যতা ও মানবিকতা ইত্যাদি সব ধরনের গুণই এর অন্তর্ভুক্ত। হযরত খাদীজা রাযি. প্রিয় নবীজীর চরিত্রের বিবরণ দিতে গিয়ে এদিকে ইঙ্গিত করেই বলেছেন ‘আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করেন। অসহায়ের বােঝা বহন করেন। অনাথ নিঃস্বকে দান করেন। উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। মেহমানের মেহমানদারী করেন। সত্য-ধর্মের পথে লােকদেরকে সাহায্য করেন।’
.
আর যদি কোন ব্যক্তির ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের মুখেই এমন বিবরণ প্রকাশ পায়? যিনি ছিলেন মহা সত্যবাদী ও পরম বিশ্বাসী। যিনি প্রবৃত্তির তাড়নায় কখনাে কোন কথা বলতেন না। তাহলে তা হবে সে ব্যক্তির ব্যাপারে সবচে বড় স্বীকৃতি, অনেক বড় পদবী এবং সর্বোচ্চ মর্যাদা। যে মর্যাদার প্রতি বিপুল উৎসাহের সঙ্গে চেয়ে থাকে অসংখ্য চোখ। যে মর্যাদা অর্জনে ভীড় জমায় শত শত লােক।
.
একবার রাসূলের দরবারে নাজরানের একটি প্রতিনিধিদল এসেছিলো।
যারা ছিলাে খৃষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী। রাসূল (সা.) তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ঈসা আ. সম্বন্ধে তাদের সাথে কিছুটা কথা কাটাকাটিও হয় রাসূলের (সা.)। আর ঠিক তখনই সূরা আলে ইমরান-এর শুরুর দিকের প্রায় আশিটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। তাতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
.
“আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মতাে। আল্লাহ তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেন। তারপর তাঁকে বলেন, ‘হয়ে যাও’। ফলে সে হয়ে যায়। সত্য সেটাই, যা আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে। সুতরাং আপনি সন্দেহকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আপনার কাছে। (ঈসা আ. সম্পর্কে) যে সঠিক জ্ঞান এসেছে, তারপরও যারা এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদেরকে বলুন- এসাে, আমরা ডেকে আনি আমাদের সন্তানদেরকে এবং তােমরা তােমাদের সন্তানদেরকে। আমরা আমাদের স্ত্রীদেরকে এবং তােমরা তােমাদের স্ত্রীদেরকে। আমরা আমাদের নিজ লােকদেরকে আর তােমরা তােমাদের নিজ লােকদেরকে। তারপর আমরা সবাই মিলে আল্লাহর সামনে অনুনয়
বিনয় করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লা’নত পাঠাই।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৫৯-৬১)
.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদেরকে ‘মুবাহালার’ আহ্বান করেন। কিন্তু তারা তা থেকে বিরত থাকলাে। এবং নিজেদের ধর্মের অনুসারী থেকেই ‘জিযিয়া-কর’ প্রদানে সম্মত হলাে। এরপর তারা রাসূলের কাছে তার সাহাবীদের মধ্য থেকে একজন বিশ্বস্ত লােককে তাদের সঙ্গে পাঠানাের আবেদন করলাে। যে তাদের মাঝে ফায়সালা করবে এবং তা বিরােধপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দিবে।
.
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঠিক আছে, ‘আমি তােমাদের কাছে একজন পরম বিশ্বস্ত ও আমানতদার ব্যক্তিকে পাঠাবাে।’
.
এ ঘােষণা শােনার পর সকল সাহাবী অধীর হয়ে পড়লেন! সকলেই এ আকাঙ্ক্ষা করতে লাগলেন- আমিই যেন হই সে ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কোথায় আবু উবায়দা! আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) কাছে এসাে! তিনি এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ হলাে এ উম্মাহর বিশ্বস্ত ব্যক্তি। (বুখারী- ৪৩৮০, মুসলিম-২৪১০)
.
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব কখনাে আমার এতটা প্রিয় ছিলাে না, সেদিন যতটা প্রিয় ছিলাে রাসূলের সে উক্তির অধিকারী হওয়া। মনের আকুতি বুকে চাপা দিয়ে যােহরের নামাযে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করলেন। সালাম ফিরিয়েই ডানে-বামে তাকালেন। রাসূলের (সা.) দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমি মাথা তুলে তাকাতে থাকলাম। তিনিও চোখ তুলে তাকাতে তাকাতে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহকে দেখতে পেলেন। তাকে ডেকে বললেন, ‘আবু উবায়দা! এদের সঙ্গে যাও, তাদের মাঝে যথাযথ ফায়সালা করবে। তাদের ঝগড়াঝাটি ও মতবিরােধের নিরসন করবে।’ উমর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, হায়! তাহলে আবু উবায়দাই এ সৌভাগ্যের অধিকারী হলেন!
.
এ আবেগ-আকুতি ও আকাক্ষা শুধু উমরের (রা.) একার ছিলাে না। সকল সাহাবীরই এ প্রত্যাশা ছিলাে- তিনিই যেন হতে পারেন সে ব্যক্তি। যখন সে ভাগ্যবান ব্যক্তিটি সবারই অজানা, তাহলে শুধু উমর (রা.) কেন, মুসলমানদের মাঝে আবু উবায়দার মতাে হওয়ার প্রত্যাশী অসংখ্য থাকবেন, সেটাই তাে স্বাভাবিক কথা।
.
আবু নাজীহ্ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তার সঙ্গীদের বলেছিলেন, তােমরা এমন মর্যাদার প্রত্যাশী হও; হওয়া উচিৎ। তবে শােনাে, আমার যা আশা ও প্রত্যাশা, তা হলাে- আমি চাই এমন এক মানবপ্রাসাদ, যা থাকবে আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহর (রা.) মতাে অসংখ্য লােকে লােকারণ্য। একজন বলে উঠলেন, তাহলে তাে ইসলামে আর কোন অসম্পূর্ণতাই থাকে না! উমর (রা.) বললেন, হ্যা, এটাই আমি চাই।
.
আশা-প্রত্যাশা তা-ই হওয়া উচিৎ, যা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির কারণ হবে।
.
.
তথ্যসূত্রঃ সাহাবীদের অন্তদৃষ্টি (পৃষ্ঠা ২১)
লিখাটি ফেসবুক এর “Know Your Heroes – উম্মাহর নক্ষত্ররাজি” পেইজ থেকে নেয়া






